ঢাকা, রবিবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৮ মে ২০২৫, ২০ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

উপকূল থেকে উপকূল

কুকরি মুকরির সাংবাদিক মোসলেম!

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১:৫০, মার্চ ১৩, ২০১৪
কুকরি মুকরির সাংবাদিক মোসলেম! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চর কুকরি মুকরি, চরফ্যাশন, ভোলা থেকে: খবর আছে, খবর! কুকরিতে কৃষি ব্যাংকের ম্যানেজার সাহেব আসবেন। যাদের বকেয়া লোন আছে পরিশোধ করিতে পারিবেন।

ম্যানেজার সাহেব জাহাঙ্গীরের দোকানে বসিবেন ইনশাআল্লাহ।

এক হাতে লাঠি, আরেক হাতে একটি টিনের খালি জার। লাঠি দিয়ে টিনের ওপর শব্দ করে জোরালো কণ্ঠে সদ্য এই খবরটি প্রচার করছিলেন কুকরি মুকরি বাজারের মোসলেম উদ্দিন। তিনিই এ দ্বীপের খবর প্রচারের একমাত্র মাধ্যম। তার মাধ্যমে মুহূর্তে যেকোনো সংবাদ পৌঁছে যায় ইউনিয়নটির প্রাণকেন্দ্র পুরান বাজারের সবার কাছে।

মোসলেম উদ্দিন কুকরি মুকরি দ্বীপের ‘সাংবাদিক’। এলাকার মানুষের গরু-মহিষ কিংবা ছাগল হারানো, ইউনিয়ন পরিষদের ভিজিডি-ভিজিএফ বিতরণ, বয়স্ক ভাতা বিতরণ, কৃষি ব্যাংকের ঋণ আদায়, বাগদা চিংড়ির দাম বৃদ্ধিসহ সব খবর প্রচার করেন তিনি। এ সাংবাদিকের কাগজ-কলম নেই। প্রচারের জন্য পত্রিকা-টেলিভিশনের প্রয়োজন নেই। জোরালো কণ্ঠে বাজারের সবার কাছে খবর পৌঁছে দেন তিনি। খবর প্রচারে ইচ্ছুক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান খবরের বিবরণ দেয় মোছলেমের কাছে, সাংবাদিক হয়ে তা প্রচার করে দেন তিনি।

কোনো ব্যক্তির গরু হারানোর খবর মোসলেম উদ্দিন জানিয়ে দেন এভাবে, ‘খবর আছে, খবর! কালি বাজারে রতন কাইল দুইডা গরু হারানো গ্যাছে। একটা দামড়ি বাছুর, কপালে চান। আরেকটা দামড়া বাছুর, ডান সাইডে কান কাডা। যদি কোনো লোক পাইয়া থাহেন বা কোনো সন্ধান থাইক্যা থাহে বাজার কমিটির সভাপতির কাছে জানাবেন’।
 
মোসলেম জানান, প্রতিমাসে ৮-১০টি খবর প্রচারের দায়িত্ব পান তিনি। বৃহস্পতিবার হাটের দিন থাকায় খবরের সংখ্যা বেশি থাকে। দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে খবর প্রচারের সম্মানীও বেড়েছে। আগে প্রতি খবরে ২০ টাকা করে দেওয়া হলেও এখন খবর প্রতি তার সম্মানী ৫০ টাকা। তবে অনেকে দর কষাকষি করে এ মূল্য কমানোর চেষ্টা করেন।      

সূত্র বলছে, কুকরি মুকরি বাজারে টিনের জার পিটিয়ে খবর প্রচারের প্রচলন যুগ যুগের। তারই ধারাবাহিকতায় এখন এ খবর প্রচারের দায়িত্ব মোসলেম উদ্দিনের ওপর। এর আগে জিল্লুর রহমান, শাহজাহান মৃধা, শহিদ কবিরাজ, নজির আহমেদ শিয়ালীসহ অনেকেই এ দায়িত্ব পালন করেছেন। সর্বশেষ জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পর এ দায়িত্ব পরে মোসলেম উদ্দিনের ওপর।



মোসলেম উদ্দিনের বাড়ি কুকরি মুকরি বাজার থেকে খানিক দূরে বাবুগঞ্জ গ্রামের পশ্চিম প্রান্তে। পাঁচ ছেলে-মেয়ের বাবা তিনি। বাজার কমিটির সিদ্ধান্তে তাকে রাতে বাজারের পাহারার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এজন্য কমিটি নির্দিষ্ট কোনো বেতন দেয় না। সম্মানী হিসাবে বাজারের প্রতিটি দোকান থেকে প্রতিদিন চার টাকা করে তুলে নেন মোসলেম। পাহারার কাজের পাশাপাশি সংবাদ প্রচারের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

রাতের পাহারাদার হিসাবে রাত এগারোটার পর ডিউটি শুরু হলেও মোসলেম উদ্দিনের কাজ শুরু হয় বিকাল ৫টা থেকেই। নতুন কোনো খবর থাকলে তা প্রচার করেন, বাজারের সব দোকান থেকে চার টাকা করে সংগ্রহ করেন। এরপর শুরু করেন রাতের ডিউটি। ভোর সাড়ে ছয়টায় তার ডিউটি শেষ হয়। দিনের অধিকাংশ সময় ঘুমিয়ে কাটান।

কুকরি মুকরির স্থানীয় সংবাদ সবাইকে জানিয়ে দেয়ার সাংবাদিক মোসলেম। কিন্তু স্থানীয় সংবাদ জাতীয় কিংবা আঞ্চলিক পত্রিকায় পাঠানোর মতো সাংবাদিক নেই এখানে। এখানে আসে না কোনো সংবাদপত্র। ডিস লাইন না থাকায় বিটিভি ছাড়া কোনো চ্যানেল দেখার সুযোগ নেই। কিছু মানুষ হয়তো মোবাইলের মাধ্যমে সংবাদ দেখেন।

সংবাদপত্র আর টেলিভিশন চ্যানেলবিহীন দ্বীপ কুকরি মুকরির অধিকাংশ মানুষই সারা বছর থাকে তথ্যশূন্যতায়। আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির এ যুগে এখানকার মানুষ এখন এ অবস্থা থেকে মুক্তি চান।       
  
বাংলাদেশ সময়: ০১৫৯ ঘণ্টা, মার্চ ১৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।