ঢাকা: জীর্ণ শরীর, স্থির দৃষ্টি, মাথায় গামছা জড়ানো। কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছেন পঞ্চাশোর্ধ জাহাঙ্গীর।
তবে ‘মুক্তিযুদ্ধের ফেরিওয়ালা’ নামেই বেশি পরিচিতি লাভ করেছেন জাহাঙ্গীর।
রাজবাড়ী সদর উপজেলার রামকান্দপুর তালুকদার পাড়ায় আতাহার মুন্সির ঘরে জন্ম হয় তার জাহাঙ্গীর মুন্সির। অভাবের কারণে লেখাপড়া এগিয়ে নিতে পারেননি লেখাপড়া। এরপর তিনি ঢাকায় চলে আসেন। অন্যের বাড়িঘর মেরামত করে চলে তার সংসার।
রাজধানীর পশ্চিম আগারগাঁওয়ের একটি খালি জায়গায় স্ত্রী, চার ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে সংসার তার। ২৭ বছর যাবৎ এ এলাকায় বসবাস করছেন তিনি। দিন মজুরি করে সারা বছর সংসার চললেও স্বাধীনতা এবং বিজয় দিবসের আগে নেশাই হয়ে ওঠে তার মূল চিন্তাভাবনা।

আর তাকে সহায়তা করে নরসুন্দর মধু গোপাল, রাজমিস্ত্রি সাইদুল ইসলাম ও আবুল হোসেন এবং চায়ের দোকানদার বশির উদ্দিন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনা ছড়িয়ে দেওয়াই জাহাঙ্গীরের নেশা।
গলায় ঝোলানো দূরবীন, হাতে স্টেন গান। পাশে ট্যাংক। গোলা ছুড়ে মারবে এখনি। ভয়ে হতবিহ্বল পাকিস্তানি সেনারা। তবে এ গুলো সত্যি ঘটনা নয়, কাঠ দিয়ে বানানো। ৭১-কে মূর্ত করতেই এগুলো প্রতিবছর বানান জাহাঙ্গীর মুন্সি। দিন মজুরির পাশাপাশি বাঁশ-কাঠ দিয়ে যুদ্ধ সরঞ্জাম তৈরি করে সুবিধাবঞ্চিত শিশু-কিশোরদের হাতে দেন তিনি। আর গল্প শোনান মুক্তিযুদ্ধের।
আলাপকালে জাহাঙ্গীর বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল ১১ বা ১২। সে কারণে বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে যেতে পারিনি। তবে রাজাকাররা আর পাকিস্তানি আর্মিরা যে সব কর্মকাণ্ড করেছে, তা আমি দেখেছি। এখনও তা ভুলতে পারিনি।

তিনি বলেন, এখনকার সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তথ্য জানে না। জানার সুযোগও নেই। এরা অল্প কিছু হলেও যেন জানতে পারে, সে চেষ্টাই করে যাচ্ছি। খালি মুখে বললে শিশুরা শুনতে চায় না। তাই, যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করে মুক্তিযুদ্ধের বাস্তব চিত্র তুলে ধরে ওদের আগ্রহী করি। দূরবীন দেখিয়ে বলি, আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি আর্মি আর রাজাকারদের দূর থেকে দেখার জন্য এই যন্ত্র ব্যবহার করেছিল।
প্রতিবছর ২৬ মার্চ ও বিজয় দিবস এলে জাহাঙ্গীর মুন্সি নিজে কাঠ দিয়ে ট্যাংক বানান। বানান কামান। এছাড়া কাঠের অস্ত্র বানান তিনি। ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বর এ সব দিয়ে র্যালি করেন। শিশুরা র্যালিতে এ সব বহন করে। তখন জাহাঙ্গীর মুন্সির বুক আনন্দে ভরে ওঠে। সম্পূর্ণ নিজের সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেই কৃত্রিম রণাঙ্গন তৈরি করে শিশুদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শেখান।
এ ছাড়া বাড়ির উঠানে গাছ দিয়ে ট্যাংক, মানুষসহ বিভিন্ন কাঠামো গড়ে তুলেছেন। তার বাড়ির উঠান দেখলে মনে হবে যেন, যুদ্ধের মাঠ।

সেখানে গাছ দিয়ে বানানো আছে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ। মুক্তিযোদ্ধা ইত্যাদি। তবে আর্থিক কারণে সেগুলো ভালোভাবে সংরক্ষণ করতে পারছেন না জাহাঙ্গীর মুন্সি। ফলে, অনেক চিহ্নই মুছে গেছে জানালেন তিনি।
জাহাঙ্গীর মুন্সি জানালেন, আর্থিক সংকটের কারণে অনেক কিছুই করতে পারি না।
কেউ আর্থিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, তেমন কোনো সহযোগিতার হাত পাইনি। সরকার কিংবা বিত্তবান কেউ আমার কাজে সহযোগিতা করলে আমি আরো বড় পরিসরে এ সব করতে পারতাম। যা করি, শুধুমাত্র বিবেকের তাড়নায় করি। কিন্তু চাইলেই সবকিছু করতে পারি না।

তিনি জানান, এর আগেও আমার এ সব নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু কারো কাছ থেকে তেমন কোনো সাড়া পাইনি। কেউ সাড়া দিক বা না-দিক বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসি বলেই আমি প্রতিবছর মুক্তিযুদ্ধের এই রণাঙ্গন তৈরি করবো। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সৃষ্টির প্রকৃত ইতিহাস এভাবেই মৃত্যুর আগ পর্যন্তই গড়ে যাবো। এটা আমার বিবেক ও ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধতার অঙ্গীকার!
বাংলাদেশ সময়: ২১০৮ ঘণ্টা, মার্চ ২৬, ২০১৪