ঢাকা, শনিবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৭ মে ২০২৫, ১৯ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

উপকূল থেকে উপকূল

স্কুল ভবন যেন ইটের কঙ্কাল!

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩:৩৪, মার্চ ২৭, ২০১৪
স্কুল ভবন যেন ইটের কঙ্কাল! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

রাঙ্গাবালী, পটুয়াখালী ঘুরে এসে: স্কুল ভবন না বলে এগুলোকে ‘ইটের কঙ্কাল’ বলাই ভালো। ইটের ওপর বালু-সিমেন্টের প্রলেপ খসে খসে পড়ছে।

বেরিয়ে গেছে ইট। কোথাও ভয়ঙ্কর ফাটল। দেয়াল ও ছাদে বৃষ্টির পানি চুইয়ে পড়ার ছাপ স্পষ্ট। শ্রেণীকক্ষের ভেতরে জঞ্জালে পরিপূর্ণ।

নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে বানানো এসব পরিত্যক্ত ভবনে এখনও লেখাপড়া শিখছে প্রত্যন্ত পল্লীর শিশু-কিশোরেরা।

এ চিত্র সরকারের উর্ধ্বতন মহলের জানা আছে, নজরে আছে স্থানীয় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের। তারপরও দেশের দক্ষিণ উপকূলের পটুয়াখালী জেলার দ্বীপ উপজেলা রাঙ্গাবালীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এ বেহালদশা কাটছে না। বছরের পর বছর ক্লাস হচ্ছে এসব পরিত্যক্ত ভবনে।

প্রতিনিয়ত দুর্যোগের হুমকির মুখে থাকা এসব পরিত্যক্ত ভবনে স্কুল চলাকালে দুর্ঘটনা ঘটলে দায় কে নেবে, এ প্রশ্নের জবাব নেই কারও কাছে।  

তথ্যসূত্র বলছে, ঘূর্ণিঝড় মহাসেনে ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ দেখে সরকারের উর্ধ্বতন মহল থেকে ঝুঁকিপূর্ণ স্কুল ভবনগুলোর জন্যে এক লাখ টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ টাকা দিয়ে টিনশেড ভবন তুলে ক্লাস নিতে বলা হয়েছে। ৩-৪শ’ ছাত্র-ছাত্রীর একটা সরকারি স্কুল চালাতে মাত্র একলাখ টাকায় কী ঘর বানানো সম্ভব হবে, তার হিসাব মেলাতে পারছেন না স্কুল ম্যানেজিং কমিটি কিংবা এলাকাবাসী।  



সরেজমিনে ঘুরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জীর্ণদশা চোখে পড়ে। স্কুলগুলোর এ অবস্থা যে কারও ধারণার বাইরে। স্কুল ভবন পরিত্যক্ত। ছাদ চুইয়ে পড়ছে পানি। ইটের ওপর বালু-সিমেন্টর আবরণ অনেক আগেই ঝরে পড়েছে। যেকোনো সময় স্কুল ভবন ধসে ঘটতে পারে বড় ধরণের দুর্ঘটনা। স্কুলের নলকূপ আর টয়লেট ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে অনেক আগেই।  

রাঙ্গাবালী উপজেলা সদর থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে রসুলবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আবু জাফর বাংলানিউজকে জানালেন, তার স্কুলের ভবন পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে আগেই। তারপরও এখানে ক্লাস নিতে হচ্ছে। বিকল্প ব্যবস্থার জন্য সরকার এক লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কক্ষে কথা বলার সময় দেখা গেলো, ময়লা-জঞ্জালের ভেতরে রাখা একটি ছোট্ট টেবিল। পাশের চেয়ারে বসেন প্রধান শিক্ষক। রয়েছে একটি অতি পুরানো আলমারি। এ কক্ষের ভেতরে এলেমেলো করে রাখা হয়েছে বিস্কুটের পরিত্যক্ত কার্টন, কিছু ভাঙ্গা আসবাবপত্র। ক্লাসের কক্ষগুলোর অবস্থা আরও খারাপ।

এরই মধ্যে লেখাপড়া করছে এ বিদ্যালয়ের শিশু শ্রেণীর ৪০ জন, প্রথম শ্রেণীর ৪৮ জন, দ্বিতীয় শ্রেণীর ৪৯ জন, তৃতীয় শ্রেণীর ৪৮ জন, চতুর্থ শ্রেণীর ৩৬ জন আর পঞ্চম শ্রেণীর ৩৯ জন শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থী ইমরান বললো, স্কুলের ইট খুলে খুলে পড়ে। বৃষ্টির সময় পানি পড়ে। আমরা সব সময় ভয়ে থাকি। তবুও তো স্কুলে আসতে হয়।   

উপজেলা সদরের কাছে গণ্ডাদুলা এম এইচ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থাও একই। বিদ্যালয় ভবনের দু’পাশে দু’টো নলকূপ আছে, কিন্তু একটিও সচল নেই। এটিও পরিত্যক্ত ভবন। ক্লাস চলছে ঝুঁকি নিয়ে। প্রায় দশ বছর ধরে এ বিদ্যালয়ে ঝুঁকি নিয়ে ক্লাস হচ্ছে বলে জানালেন বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আবদুল আজিজ।



সরেজমিনে ঘুরে ও সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে বাংলানিউজ জানতে পারে, রসুলবাড়িয়া আর গণ্ডাদুলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় দৃষ্টান্ত মাত্র। এ দ্বীপ উপজেলার অধিকাংশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থা একই রকম। শুধু অবকাঠামোগত অবস্থা নয়, বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপে বোঝা গেলো, এসব বিদ্যালয়ের লেখাপড়ার মানও অত্যন্ত নিচু।  

গণ্ডাদুলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীতে এক নম্বর রোলধারী মানসুরা বেগম বলতে পারলো না বিজয় দিবস কবে। জবাব দিতে পারলো না স্বাধীনতা দিবস কবে। এমনকি শহীদ দিবস কিংবা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস কবে সেটাও বলতে পারলো না। অথচ কয়েকদিন আগেই এই স্কুলের শিক্ষার্থীরা সামনের মাঠে কলাগাছের শহীদ মিনার বানিয়ে দিবসটি পালন করেছে।

শুধু মানসুরা একা নয়, একই বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর রাহাত ও মামুন, চতুর্থ শ্রেণীর আফরোজা, তৃতীয় শ্রেণীর অন্তর ও ওমর ফারুক, রসুলবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর নাজমুল, পঞ্চম শ্রেণীর তহমিনা, ইমরানসহ অনেকেই এসব সাধারণ প্রশ্নের জবাব দিতে পারেনি।    

বড় শহরে বসে হয়তো ভাবা যায় না, প্রত্যন্ত গ্রামে প্রাথমিকে পড়ুয়া ছেলে-মেয়েরা একটা জাতীয় পত্রিকা কিংবা টেলিভিশন চ্যানেলের নাম বলতে পারে না। রাজধানী থেকে অনেক দূরে সমুদ্রপাড়ে অবস্থিত রাঙ্গাবালীর এসব গ্রামের এটাই বাস্তবচিত্র। বাজার থেকে পুরোনো খবরের কাগজে মোড়ানো পণ্য হয়তো ওইসব ছেলে-মেয়েদের ঘরে যাচ্ছে, ছেঁড়া খবরের কাগজ দিয়ে হয়তো কেউ কেউ বইয়ের মলাটও দিচ্ছে, কিন্তু আট কলামের একটা পূর্ণাঙ্গ খবরের কাগজ ওদের চোখে পড়েনি।    
 
রাঙ্গাবালী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা সুশেন চন্দ্র হাওলাদার বাংলানিউজকে বলেন, ক্লাসে ছেলে-মেয়েদের অনেক কিছুই পড়ানো হয়। কিন্তু অভিভাবকদের মাঝে সচেতনতা নেই বলেই ওরা বাইরের জগৎ সম্পর্কে চর্চার সুযোগ পায় না।                
         
বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত সমস্যা আর শিক্ষক স্বল্পতা তুলে ধরে তিনি বলেন, উপজেলার ৬৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র ৪টিতে ৪ জন করে শিক্ষক রয়েছেন। বাকিগুলো চলছে ৩ জন কিংবা ২ জন শিক্ষক দিয়ে। অবকাঠামোগতভাবে উপজেলার অন্তত ২৮টি বিদ্যালয়ের অবস্থা বেশি খারাপ। এ বিষয় নিয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বার বার লেখা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশ সময়: ০৩২৫ ঘণ্টা, মার্চ ২৭, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।