ঢাকা, শনিবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৭ মে ২০২৫, ১৯ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

বাঁশের স্বয়ংক্রিয় দরজা

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮:০১, এপ্রিল ৬, ২০১৪
বাঁশের স্বয়ংক্রিয় দরজা ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কাপ্তাই (রাঙ্গামাটি) থেকে: বাঁশের তৈরি স্বয়ংক্রিয় প্রধান ফটক। আর অস্ত্রাগার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে গ্রামাঞ্চলের ‘চড়াই ঘর’ সদৃশ্য ছোট্ট মাটির খুপরি।


 
প্রধান ফটকটি বাঁশের তৈরি হলেও রয়েছে বিশেষ মুন্সিয়ানা। কোনো রকম যন্ত্র বা হাতের সাহায্য ছাড়াই স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যায় গেটটি। যেমনটি করপোরেট অফিস গুলোতে দেখা যায়। কেউ প্রবেশ অথবা বের হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে দরজা বন্ধ হয়ে যায়।
 
পর্যটন শহর রাঙ্গামাটির কাপ্তাই উপজেলার কাটাখাল আনসার বাহিনীর বেস ক্যাম্পে রয়েছে এই বিশেষ ফটকটি।
 
শহরে দরজাকে স্বয়ংক্রিয় করতে স্পিং ব্যবহার করা হয়। কিন্তু আনসার ক্যাম্পটিতে একটি বাঁশের সাহায্যে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে অত্যন্ত অভিনব কৌশলে।
 
দেখার আগে বলা হলে হয়তো বিশ্বাস করতে চাইবেন না অনেকেই। কিন্তু নিজের চোখে দেখার পরে মনে হবে এর চেয়ে সহজ বিষয় আর একটিও নেই।
 
একটি বাঁশ ও কয়েক গজ রশি দিয়ে নিপুণভাবে এই স্বয়ংক্রিয় দরজাটি তৈরি করা হয়েছে। মূল ফটকটির যেদিকে মুভ করছে ফটকের কপাটটি, বিপরীতমুখি করে ধনুকের মতো একটি বাঁকা বাঁশ মাটিতে বসানো হয়েছে। কয়েক গজ রশি দিয়ে বাঁশটির মাথার সঙ্গে দরজাটি আটকে দেওয়া হয়েছে। গেটটি খোলা হলে বাঁশের মাথাটিতে চাপ পড়ে বেঁকে যাচ্ছে। ছেড়ে দেওয়ার সঙ্গে আবার সোজা হয়ে যাচ্ছে বাঁশটি। তার সঙ্গে সঙ্গে গেটটিও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
 
অবাক করার মতো বিষয়। দেখতে সৌখিন না হলেও নতুন এই প্রযুক্তি পযর্টকদের কাছে বাড়তি বিনোদন নিয়ে হাজির হয়েছে। অনেকে মূল ফটকটিকে স্মৃতির পাতায় ধরে রাখতে ছবি তুলছেন।
 
প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক ফটকটিকে খুটিয়ে দেখেন বলে জানান আনসারের প্লাটুন কমান্ডার (এপিসি) আব্দুল কুদ্দুছ।
 
জিপতলী সেনাক্যাম্প থেকে ২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিলেই কাটাখাল আনসার ক্যাম্প। টিলাটিকে কেটে কাপ্তাই লেকের সঙ্গে ক্যানেল তৈরি করায় এর নাম কাটাখাল হয়। জিপতলী চেয়ারম্যানপাড়া গ্রাম সংলগ্ন টিলাটিকে দু’ভাগে বিভক্ত করে ফেলেছে সরু খালটি।
 
উত্তরে অবস্থিত সেনাবাহিনীর ক্যাম্পের দিক থেকে সরাসরি গাড়ি নিয়ে পৌঁছার কোনো সুযোগ নেই। খালটিতে ৩ফুট প্রস্তের ঝুলন্ত ব্রিজ রয়েছে। যা দিয়ে জনগণ পায়ে হেঁটে পারাপার হন।
 
স্থায়ী ব্রিজ করার জন্য দু’প্রান্তে ভিত্তি তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন পার হলেও ব্রিজটি হয়নি। যে কারণে জিপতলী চেয়ারম্যান পাড়ার গ্রামে পর্যটনের সম্ভাবনা তিমিরেই থেকেছে। অথচ প্রাকৃতিক নিসর্গের লীলাভূমি বলা যেতে পারে গ্রামটিকে।
 
অসংখ্য টিলা, গহীন বন, বিশাল লেক, ছোট ছোট ক্যানেল--- কি নেই সেখানে! আমাদের সফরসঙ্গী মোজাহের রুমেন তো বলেই বসলেন, ‘এখানে কয়েক ঘণ্টার জন্য আসা উচিত হয়নি। কয়েক দিন সময় হাতে নিয়ে আসা উচিত ছিলো। ’ 
 
এক সময় সেনাবাহিনীর টহল ক্যাম্প ছিলো এখানে। শান্তিচুক্তির পর আনসার বাহিনী বেস ক্যাম্প স্থাপন করেছে। বলতে গেলে বিদ্যুৎ সংযোগ ছাড়া আর কোনো আধুনিকতার স্পর্শ নেই সেখানে।
 
মাটির ঘরেই থাকেন আনসার সদস্যরা। একটি পাকা কক্ষ রয়েছে কমান্ডারের জন্য। ওয়াচ টাওয়ার মাটির, নিরাপত্তা চৌকি মাটির, এমনকি মাটির তৈরি ৩ ফুট উচু একটি খোপ অস্ত্রাগার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। গ্রামের লোকজন যাবে ‘চড়াই ঘর’ বলেই মনে করবে।
 
বজ্রপাত নিরোধক দণ্ড আকাশ পানে উঁকি দিচ্ছে। ক্যাম্পটিতে দাঁড়িয়ে নিচে লেকে তাকালে মনে হবে কোনো বড় পাহাড়ের চূড়ায় উঠেছি। বহমান নির্মল বাতাস যে কারো মনকে পুলকিত করে তুলবে।
 
দেশি নানা জাতের ফুল-ফলের পাশাপাশি নানা রকম বনজ বৃক্ষ মনকে দোলা দেবে। তার উপর বিভিন্ন প্রজাতির পাখির অবাধ বিচরণ যে কারো ব্যথিত হৃদয়কে পুলকিত করে তুলতে সহায়তা যোগাবে। চোখে পড়বে নানা রকম বিপন্ন প্রজাতির পাখির কল-কাকলি।
 
এখানে প্রতিটি মুহূর্তে প্রত্যেকটি স্থান দেখে মনে হবে একটির চেয়ে, আরেকটি সুন্দর। পিকনিকের জন্য বেশ কিছু স্পট রয়েছে। সমতল ভূমির বাসিন্দাদের এখানে না এলে জীবন ষোল আনাই বৃথা বলে মন্তব্য করেন টিটু সাহা।
 
তিনি জানান, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কাপ্তাই ট্রেনিং ইন্সটিটিউট থেকে যখন আসি। ‘নয়নাভিরা’ কথাটা  ফেল মেরেছে। বলতে হবে মহানয়নাভিরাম দৃশ্য দেখেছি।
 
মাইক্রোবাস যোগে আসার সময় তো চোখ জুড়িয়ে গেছে। যে যেদিকে তাকিয়েছে মনোরম দৃশ্য দেখার জন্য চিৎকার দিয়ে অন্যকে তাকানোর আহ্বান জানিয়েছে। কখনও ধনুকের মতো বাঁকা, কখন সোজা উপর দিকে, কখনও নিচের দিকে, কখনও সাপের মতো এঁকে বেঁকে গাড়ি চলেছে। এটা কি কম উপভোগ্য!
 
৩৪ জন সাংবাদিক পড়ন্ত বিকেলে সেখানে যাই। কেউ আনসার ক্যাম্পে, কেউ কাটাখালের ওপারে পিকনিক স্পটে, আবার একটি দল পিকনিক স্পটের অদূরে টিলার উপর অবস্থিত হেলিপ্যাডে উঠে হৈ হুল্লুড়ে মেতে ওঠেন।
 
কয়েক মুহূর্তে শহরের যান্ত্রিকতা ভুলে যেতে চেষ্টা করেন। হেড়ে গলায় গান ধরেন অনেকেই। তবে বেশিরভাগই প্রথম ১ কিংবা দুই কলি।
 
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় টিমের অন্যতম সংগঠক ফোরাম ফর এনার্জি রিপোর্টার্স বাংলাদেশ’র নির্বাহী পরিচালক অরুণ কর্মকার হাঁক ছাড়েন অনেক হয়েছে। চল এবার ফেরা যাক।
 
অর্থনীতি প্রতিদিনের রিপোর্টার ইমতিয়াজ হুসাইন বলে ওঠেন, দাদা আর কিছুক্ষণ থাকি না! অন্যরাও একে অন্যের মুখের দিকে তাকাচ্ছিলেন বিরক্ত মুখে। কিন্তু অরুণ দা বলে ওঠেন এখানে কয়েক দিন থাকলেও সাধ মিটবে না।
 
রুমে ফেরার কয়েক মিনিট পরেই মাগরিবের আজান পড়ে যায়। এবার কাপ্তাই পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কৃত্রিম লেক দেখতে বেরিয়ে পড়েন অনেকে। পায়ে হাঁটতে হাঁটতে উজানে কয়েক কিলোমিটার মিটার পথ পেরিয়ে যাই।
 
যতই যাই মনে হয় আরও একটু এগুলে ভালো লাগবে। নানা রকম আলোচনা, বেসুরো ও প্যারোডি গানে ভরপুর ছিল পথচলা। চাঁদের আলোতে দূরে আবছা দেখা যাচ্ছিল সারি সারি টিলা।


 
ফেরার পথে লেকের দক্ষিণপাড়ে মাঠে কাঠাল ও কলা বিক্রেতাকে নজরে পড়ে। একজন বলে ওঠেন ওগুলো সব্জি হিসেবে বিক্রি হচ্ছে, তরকারি খাওয়ার জন্য। বিক্রেতার কানে গেলে বলে ওঠেন না এগুলোতো পাকা কাঁঠাল।
 
এখনই খাওয়া যাবে? বিক্রেতার জবাব দেন, ‘হ্যাঁ’। প্রায় সবাই চমকে যায়। মাত্র কাঁঠালের মুচি ধরেছে এসময় আবার পাকা কাঁঠাল কেমনে হয়। সফর সঙ্গী রেডিও টুডের চিফ রিপোর্টার জুয়েল বলেন, ভালো হবে তো। বিক্রেতা বলে ওঠেন ভালো না হলে দাম নেব না।

ছোট সাইজের কাঁঠালটির দাম জিজ্ঞেস করতেই বিক্রেতা বলেন, দাম চাইলে ৬০টাকা। একদাম ৫০ টাকা। ভালোর গ্যারান্টি দিতে হবে। ভালো না হলে দাম ফেরত। আর দাম কমানোর দাবি করেন কামরুল হাসান। বিক্রেতা বলেন, গ্যারান্টি দিয়ে কম দামে দেওয়া যাবে না।
 
তখন পাল্টা জবাবে কামরুল বলেন, ঠিক আছে আর গ্যারান্টি দিতে হবে না। দামটা কিছু কম রাখেন। বিক্রেতা একগাল হেসে বলেন, গ্যারান্টিতো দিয়েই দিছি।
 
৫০ টাকাই দর চূড়ান্ত হলে বিক্রেতা কাঁঠালটি ভেঙে দেয়। ৯ জন সাংবাদিক চোখের পলকে সাবাড় করে দেন কাঁঠালটি। অসাধারণ তার স্বাদ। বিক্রেতা জানায় এগুলো বারো মেসে কাঁঠাল। সারা বছরেই পাওয়া যায়।

বাংলাদেশ সময়: ০৮০৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৬, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।