ঢাকা, শনিবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৭ মে ২০২৫, ১৯ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

দু'টো ফুল দিলেই কী মর্যাদা হয়!

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ ও মাহবুব‍ুর রহমান মুন্না | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪:৪১, মে ৩১, ২০১৪
দু'টো ফুল দিলেই কী মর্যাদা হয়!

খুলনা থেকে: চারপাশে ময়লা-আবর্জনা। বিভিন্ন প্রাণীর বিষ্ঠা ছড়ানো ছিটানো।

ফলকের ওপর নারা ময়লা কাপড়। দেখা মেলে গরু-ছাগলও। গুটিকয়েক নয়নতারা মাজারের মাটি আঁকড়ে রয়েছে অনাদরে। রাতে এখানে বসে মদ-গাঁজার আসর। দেখা মেলে ভাসমান যৌনকর্মীদের।

এমনই অনাদর অবহেলায় রয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের মাজার।

স্থানীয়দের বক্তব্য, দুটো ফুল দিলেই বীরশ্রেষ্ঠদের কী যথার্থ মর্যাদা দেওয়া হয়? যতটুকু মর্যাদা পাওয়ার কথা তার কিছুই পাচ্ছেন না দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করা এই মহান বীর।

মাজারটির পূর্বদিকে রয়েছে একটি পাকা সড়ক। যা বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন সড়ক নামে পরিচিত। উত্তর ও দক্ষিণে বেশ কয়েকটি বরফকল। পশ্চিমে ৩০ গজ দূরে রূপসা নদী। ভাঙ্গনের কারণে মাজারের জমির একটি অংশ বিলীন হয়েছে রূপসায়।

মাজারের ঠিক উল্টো (রাস্তার অপরপাশে) দিকে ওষুধের দোকানি মো. শহিদুল্লাহ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন ও বাংলাদেশের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। দুটো ফুল দিলেই যথার্থ মর্যাদা দেওয়া হয় না। জাতীয় বীরকে বর্তমান প্রজন্ম ভ‍ুলতে বসেছে।
r_3_5
শহিদুল্লাহর কথার প্রমাণ পাওয়া গেলো স্থানীয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেও। বাগমারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. আলী বলেন, রুহুল আমিনের কবর রয়েছে এখানে। উনি নাকি যুদ্ধে মারা গেছেন। আর কিছু জানি না।

এক বিঘা জমির ওপর অবস্থিত মাজারটি। মাজার চত্বরে দুটি কবর রয়েছে মার্বেল পাথরে বাঁধানো। কবর দুটির একটি থেকে অপরটির দূরত্ব ৭ ফুটের মতো। কিন্তু কোনোভাবেই বোঝার উপায় নেই কোনটি কার কবর। সেটি লেখাও নেই।

কবর থেকে ১০ ফুট দূরে দক্ষিণকোণে পাশাপাশি দুটি স্মৃতিফলকে লেখা বীরশ্রেষ্ঠ রহুল আমিন ও মহিবুল্লাহ বীরবিক্রম।

স্মৃতিফলকে তাদের শাহাদৎবরণের তারিখ ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১ লেখা রয়েছে। আর কিছুই নেই। সে কারণে ইচ্ছা থাকলেও দর্শণার্থীদের জানার সুযোগ হচ্ছে না তাদের অমর বীরত্বগাঁথা পরিচয়।  

সীমানা প্রাচীর নেই, নেই কোনো গাছপালা। দেখতে অনেকটা বিরানভূমির মতো খাঁ খাঁ করছে। সর্বত্র গরু-ছাগলের অবাধ বিচরণ।

শহিদুল্লাহ বলেন, মাজারটির উন্নয়নের নামে এর নিরাপত্তা ও জৌলুস দূর করা হয়েছে। আগে অনেক ফুল গাছ ছিল। কিন্তু এখন কোনো গাছ নেই। নিরাপত্তা প্রাচীরও নেই।

তিনি বলেন, আগে কবর দুটি হাফ প্রাচীর, তার ওপর গ্রিল দিয়ে ঘেরা ছিল। প্রবেশ দ্বারে ছিলো দরজা। তখন মাজারের পবিত্রতা রক্ষা হতো। কিন্তু এখন কোনো গেট না থাকায় পশু-পাখির বিচরণভূমিতে পরিণত হয়েছে।
r_5_
রাতের বেলা জমে ওঠে মদ-গাঁজার আসর। এর মধ্যে রয়েছে যৌনকর্মীদের অবাধ বিচরণ। পশ্চিম দিকের খালি জায়গাটুকু অনেকটাই নিচু। মাঝে তিন ফুট উ‍চুঁ মার্বেল পাথরের স্মৃতিস্তম্ভের কারণে পশ্চিমের ফাঁকা স্থানে কেউ অবস্থান করলেও রাস্তা থেকে দেখা সম্ভব নয়।

একজন পার্টটাইম কেয়ারটেকার রয়েছেন। তাকে বেতন নয়, সামান্য ভাতা দেওয়া হয়। তাও নিয়মিত নয়। যে কারণে তিনি মাঝে মধ্যে আসেন দেখতে। যেমনটি বিভিন্ন দিবসে নৌ-বাহিনী ও সরকারি কর্মকর্তারা আসেন ফুল দিতে।

স্থানীয়রা জানান, বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের কর্মক্ষেত্র নৌ-বাহিনীর লোকজন আসেন সশস্ত্র দিবসে। আর জাতীয় দিবসগুলোতে স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও প্রশাসনের লোকজন আসেন ফুল দিতে। তারপর আর কেউ খোঁজ নেন না।

স্থানীয়রা জানান, রুহুল আমিনের মেয়ে রয়েছেন। তিনি দুএকবার এসেছিলেন। আর রুহুল আমিনের পাশে শুয়ে থাকা বীরবিক্রম মহিবুল্লাহর ছেলে মাঝে মধ্যে আসেন দোয়া মাহফিল করে চলে যান।

রূপসা বাসস্ট্যান্ড থেকে বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন সড়ক ধরে মাত্র ৫০ গজ গেলেই চোখে পড়বে মাজারটি। খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ মাত্র একটি রোড সাইন দিয়ে দায় সেরেছে।

জাতীয় এই দুই বীরের বাড়ি এ অঞ্চলে নয়। স্বজনও নেই এ অঞ্চলে। এসব কারণে স্বজনহীন এই দুই বীরের কবর দুটি চরমভাবে অবহেলিত।

কেয়ারটেকার আব্দুল ওয়াহাব বাংলানিউজকে জানান, আমি সব স্বীকার করছি। কিন্তু আমি নামে কেয়ারটেকার। মাসে মাত্র ৫শ’ টাকা দেয় রূপসা উপজেলা প্রশাসন। এ দিয়ে পেট চলে না। তাই অন্যত্র কাজ করতে হয়। সকালে গিয়ে ঝাড়ু দিয়ে আসি।

রাতে মদ-গাঁজার আসর ও দেহব্যবসা প্রসঙ্গে বলেন, আমি গরীব মানুষ। আমার করার কি আছে।
r_6_
২০০৩ সালে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নতুন করে সমাধিসৌধের সংস্কার করা হয়। আগে সেখানে ইট বাঁধানো ছিল। তবে সেখানে শ্বেতপাথরে বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন ও মহিবুল্লাহ বীরবিক্রমের জীবনবৃত্তান্ত ছিল। আধুনিকায়নের সময় সেই শ্বেতপাথরটি সরিয়ে ফেলা হয়।

যে কারণে আগে যেটুকু জানার সুযোগ ছিল এখন আর তাও নেই বলে জানান স্থানীয়রা।

‘কেয়ারটেকার ওয়াহাব বলেন, হেন করা হবে, তেন করা হবে এমন অনেক কথাই শুনছি। কিন্তু কিছুইতো হচ্ছে না’

তিনি জানান, জীবনবৃত্তান্তের শ্বেত পাথরটি উল্টে প্লাস্টার করা হয়েছে আধুনিকায়নের সময়। যে কারণে এখন আর দেখা যায় না। একটি ফুলের টব বানানো হয়েছে শ্বেতপাথরটি দিয়ে।

রূপসা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, কেয়ারটেকারের জন্য কোনো বেতন বরাদ্দ নেই। নিয়ম বর্হিভূতভাবে তাকে মাসে ৫শ’ করে টাকা দেওয়া হচ্ছে।

কবর দুটি চিহ্নিত না থাকা প্রসঙ্গে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, থাকারতো কথা।

আর উন্নয়নের সময় জীবনবৃত্তান্ত সরিয়ে ফেলার বিষয়ে বলেন, আমি তখন ছিলাম না। সে কারণ বলতে পারব না।

জায়গাটি নৌ-বাহিনীর। তাদের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান মনিরুল ইসলাম।
_7_
বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন
৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী যশোর সেনানিবাস দখলের পর 'পদ্মা', 'পলাশ' এবং ভারতীয় মিত্রবাহিনীর একটি গানবোট 'পানভেল' খুলনার মংলা বন্দরে পাকিস্তানি নৌ-ঘাঁটি পি.এন.এস. তিতুমীর দখলের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ১০ ডিসেম্বর দুপুর ১২ টার দিকে গানবোটগুলো খুলনা শিপইয়ার্ডের কাছে এলে অনেক উচুঁতে তিনটি জঙ্গি বিমানকে দেখে ভারতীয় বিমান মনে করে গুলিবর্ষণ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন অধিনায়ক।

এর কিছুক্ষণ পরে বিমানগুলো অপ্রত্যাশিতভাবে নিচে নেমে আচমকা গুলিবর্ষণ শুরু করে পদ্মায় ও পরবর্তীতে পলাশে। পরিস্থিতি দেখে পলাশের অধিনায়ক লে. কমান্ডার রায় চৌধুরী নাবিকদের জাহাজ ত্যাগের নির্দেশ দেন। রুহুল আমিন আদেশ অমান্য করে যুদ্ধ চালিয়ে যান।

আহত অবস্থায় নদীর তীরে ফিরলেও রাজাকাররা তাকে বেয়নেট দিয়ে হত্যা করেন। পরবর্তীতে স্থানীয় জনসাধারণ বাগপাদুরা গ্রামে রূপসা নদীর পাড়ে তাকে দাফন করেন।

নোয়াখালীর বাগপাদুরা গ্রামে বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের জন্ম। পরে এ গ্রামের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে আমিননগর।

১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর সরকারি গেজেট নোটিফিকেশন অনুযায়ী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সাতজন বীর সন্তানকে মরণোত্তর বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। সেই তালিকাতে নাম যুক্ত করা হয় মোহাম্মদ রুহুল আমিনের।

বাংলাদেশ সময়: ০৪৩৮ ঘণ্টা, মে ৩১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।