ঢাকা, শনিবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৭ মে ২০২৫, ১৯ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

উপকূল থেকে উপকূল

নদীতে জোয়ার, স্কুলে ছুটির ঘণ্টা!

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪:২৫, মে ২২, ২০১৪
নদীতে জোয়ার, স্কুলে ছুটির ঘণ্টা! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বদরখালী, চকরিয়া, কক্সবাজার ঘুরে এসে: স্কুলঘর বর্ষায় ডোবে, ঝড়ে ওড়ে। লবণ পানিতে তিলে তিলে ক্ষয়ে যায় ইটের গাঁথুনি।

শ্রেণীকক্ষ কখনো কখনো থাকে চালাবিহীন।

দরজা-জানালা নেই অনেক কক্ষে। এতো প্রতিকূলতার ভেতরেও একটি বিপন্ন বিদ্যালয়ের সামনে পত পত করে ওড়ে জাতীয় পতাকা। লবণে পুড়ে যাওয়া ঘাসহীন মাঠে সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে জাতীয় পতাকার প্রতি সম্মান জানায় শিক্ষার্থীরা।

এ হচ্ছে উপকূলীয় জনপদ কক্সবাজারের চকরিয়ার উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরের একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের চিত্র। বাঁধের বাইরে জোয়ারের পানি বিদ্যালয় ডুবিয়ে দেয়। ঝড়ে উড়ে যায় চালা। দুর্যোগের মৌসুমে সারাক্ষণই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন শিক্ষক আর শিক্ষার্থীরা। কারণ, জোয়ারের পানি বাড়লে কিংবা মেঘে আকাশ কালো হয়ে গেলে স্কুল ছুটি দিয়ে দিতে হয়।

এতো সব সমস্যা মোকাবেলা করেও এলাকার বহু ছেলে-মেয়ে এ বিদ্যালয়ে আসছে।

বিদ্যালয়ে এসে লেখাপাড়ার সমস্যা নিয়ে দশম শ্রেণীর ছাত্র মোরশেদ জাহান তুষার বাংলানিউজকে জানায়, সমুদ্রপাড়ের এ বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে আমরা আধুনিক শিক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন। বিদ্যালয়ে কোনোমতে একটু বসার জায়গা পাই। শ্রেণীকক্ষে শিক্ষা গ্রহণের মতো পরিবেশ নেই। বর্ষা মৌসুমে তো যেকোনো সময় স্কুল ছুটি হয়ে যায়।

দশম শ্রেণীর আরেক ছাত্রী হাবিবা জন্নাত বললো, আমরা যে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারছি, এটাই ভাগ্যের ব্যাপার। এ এলাকায় নানা প্রতিকূলতায় আমাদের বাড়ি-ঘর কোনো মতে টিকে আছে, তার ওপর বিদ্যলয়ে এসেও আমাদের সেই একই সংকট। শহর এলাকার শিক্ষার্থীদের থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি।

বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যে জানা গেছে, এতো প্রতিকূলতার পরেও বিদ্যালয়ের ফলাফল তুলনামূলক ভালো। খানিক দূরে বদরখালী বাজারে অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থানে থাকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়টির চেয়ে এ বিদ্যালয়ের ফলাফল বরাবরই ভালো হয়। কিন্তু কারও সঙ্গে প্রতিযোগিতায় যাওয়ার মতো বিশেষ সুবিধা পায় না এখানকার শিক্ষার্থী।

পুরো নাম আল-আজহার মাধ্যমিক বিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৯৭ সালে। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। আর এই শিক্ষার্থীদের পাঠদানের দায়িত্ব মাত্র দশ জন শিক্ষকের। এবারের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে ৫৬ জন শিক্ষার্থী। সামনের বছর ৪৫ জন শিক্ষার্থী এসএসসি পরিক্ষা দেবে। কিন্তু এদের লেখাপাড়াটা ঠিক করে দেওয়া, আরও একটু ভালোভাবে তদারকি করার শিক্ষকের খুবই অভাব।

অধিকাংশই দরিদ্র পরিবারের ছেলে-মেয়েরা এ বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছে। বিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে নগর এলাকায় শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় আধুনিক বিষয়াদি অন্তর্ভূক্তির উদ্যোগ থাকলেও এখানে তার বিন্দুমাত্র নেই। এ বিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েরা এখনও তথ্য-প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারেনি। বিদ্যালয়ে নেই কম্পিউটার। তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন শিক্ষক থাকলেও পাঠদানের মতো কোনো ব্যবস্থা এখানে নেই।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল মাবুদ শিকদার বাংলানিউজকে বলেন, ঝড়ের সময় বিদ্যালয়ের টিন উড়ে যায়। জোয়ারের পানিতে স্কুলঘর তলিয়ে যায়। ঝড় হলে কিংবা জোয়ারের পানি বাড়লে স্কুল ছুটি দিয়ে দিতে হয়। বর্ষাকালে ছেলে-মেয়েদের স্কুলে আসতে অনেক সমস্যা হয়। বিদ্যালয়ে পাঠদান করাও কঠিন হয়ে পড়ে।

বিদ্যালয়টির চারিদিকে লবণ চাষের মাঠ। শুকনো মৌসুমের পুরো সময়টা চারদিকে লবণ পানি থাকার কারণে বিদ্যালয়ের ইটের গাঁথুনি ক্ষয়ে যাচ্ছে। বার বার মেরামত করা হলেও বেশিদিন টিকছে না। আবারও মেরামতের সময় এসে দাঁড়ায়। লোনা পানিতে বিদ্যালয়ের মাঠে কিংবা আশাপাশে নেই একমুঠো সবুজ ঘাস। বিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েরা লোনা মাটির মাঠেই খেলাধুলা করে।   

বিদ্যালয়ের পাশের গ্রামের অভিভাবকেরা জানান, দুর্যোগপ্রবণ এ এলাকার মানুষেরা সংসার চালান অতি কষ্টে। এর ওপর ছেলে-মেয়েদের স্কুলে পাঠানো প্রত্যেকের কাছেই বাড়তি চাপ। তারপরও সকলেই ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া করাতে চান। মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে চান। তাই প্রান্তিক এ এলাকার শিক্ষার সংকট লাঘবে সরকারের এগিয়ে আসা উচিত।                       

[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: ri_montu@yahoo.com ]

বাংলাদেশ সময়: ০৪২৫ ঘণ্টা, মে ২২, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।