বাংলাদেশে যে পরিমাণ তেল উৎপাদন হয়, তা আমাদের চাহিদার মাত্র ২২ ভাগের ১ ভাগ পুরণ করে। ফলে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে বাকি ২১ ভাগ তেল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।
পামওয়েল নামক গাছটি ভোজ্য তেলের একটি বিশুদ্ধ ও সমৃদ্ধ উৎস। এ মহাদেশে দক্ষিন পূর্ব এশিয়ায় সর্বপ্রথম পাম গাছ লাগানো হয়্। ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বিপের বোগার বোটানিক্যাল গার্ডেনে ১৯৪৮ সালে এই গাছ দেখা যায়। এর বৈজ্ঞানিক নাম এলিইস গিনিনিসি। আদি নিবাস আফ্রিকা মহাদেশে। ১৯১১ সালে মালয়েশিয়ায় শোভা বর্ধন উদ্ভিদ হিসেবে প্রথম পাম গাছ রোপন হয়। ১৯১৭ সালে সেলাঙ্গর জেলার তেনামারানে প্রথম বানিজ্যিকভাবে পাম চাষ শুরু হয়। বর্তমানে মালয়েশিয়ায় পামতেল শিল্পে তিন লক্ষ পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি শ্রমিক কর্মরত। জাতীয় অর্থনীতিতে প্রায় ৬.৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অধিক অবদান রাখছে।
গবেষণায় দেখা গেছে বাংলদেশের মাটি ও আবহাওয়া পাম চাষের অত্যন্ত উপযোগী। বাংলাদেশে একজন পামচাষ করে তিন জনের চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত পামতেল বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারে। চাষাবাদ ও সঠিক পরিচর্যা, বিক্রয় বিপণন, পরিবহণ এর মাধ্যমে কর্মসংস্থান হতে পারে কয়েক লক্ষ লোকের। বর্তমান বাংলাদেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে বেকারত্ব দূরিকরনে ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উন্নত করণে পামচাষ হতে পারে একটি অপার সম্ভবনাময় কৃষিক্ষেত্র।
বাংলাদেশে সর্ব প্রথম ১৯৭৮ সালে বন বিভাগের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর উদ্যোগে সিলেটের হবিগঞ্জ, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে প্রায় ৭০০ হেক্টর জমিতে পাম গাছের চারা রোপণ করা হয়।
পরে বাংলাদেশ পাম অয়েল উন্নয়ন প্রকল্পের কর্ণধার টাঙ্গাইলের ঘাটাইল থানার পাকুটিয়া গ্রামের জনাব মো. ওসমান গণী ১৯৯৭ সালে মালয়শিয়া থেকে টেনোর [ডি এক্সোনি] জাতের কয়েকটি পাম বীজ সংগ্রহ করে চারা উৎপাদন করে তা পরীক্ষামূলকভাবে চাষাবাদ শুরু করেন। দেখা গেছে এদেশের মাটিতে মালয়েশিয়ার জমির তুলনায় দ্বিগুনেরও বেশি ফলন পাওয়া গেছে। মোঃ ওসমান গণী পাম চাষে সাফল্যের জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থা হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনাল ও মাদার তেরেসা গোল্ড কাপ ’০৯ পদক লাভ করেন।
পাহাড়ি, চর অঞ্চল এবং সমতল ভূমি ও বাড়ির আঙিনায় পাম অয়েল গাছ চাষাবাদ করা যায়। এই গাছ বন্যার পানিতে মরে না। পাম অয়েল গাছ চাষাবাদ করতে তেমন রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে হয় না। দেড় থেকে দুই বৎসরের চারা রোপণ করতে হয়।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে পাম অয়েল গাছ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পাম অয়েল গাছ চাষে নূন্যতম রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয়। পাম ফল থেকে পাম অয়েল আহরণের সময় যে পুষ্টি সমৃদ্ধ পুনঃব্যবহারযোগ্য বর্জ্য পাওয়া যায় তা-ই পাম অয়েল বাগানে সার হিসেব ব্যবহার করা হয়। রাসায়নিক কিটনাশকের ব্যবহার হ্রাস করার জন্য পাম অয়েল উদ্ভিদ বালাই নিয়ন্ত্রণের কাজে জৈব পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
শিল্পের গবেষণা ও উন্নয়ন উদ্ভত দুটি ধারণা যথাÑ শূন্য বর্জ্য ও শূন্য দহন এখন ব্যপকভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে। শূন্য বর্জ্যরে ফলে পাম অয়েল গাছের পাতা, গুড়ি, ফলের শূন্য কাঁদি ব্যাবহার করেও নতুন নতুন দ্রব্য উৎপন্ন করা সম্ভব। আর শূন্য দহন ধারণার কার্যকর প্রয়োগ হচ্ছে পুরনো গাছগুলোকে না পুড়িয়ে খণ্ড খণ্ড করে চাষের জমিতে পঁচিয়ে মিশিয়ে দেওয়া , ফলে দূষণ পরিহার করা ও উদ্ভিদের পুষ্টি পদার্থ মাটিতে ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব। এছাড়া পাতা জমিতে সার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। পাম গাছের ১ টন শুকনো পাতা মাটিতে ৭.৫ কেজি নাইট্রোজেন, ১.০৬ কেজি ফসফরাস, ৯.৮১ কেজি পটাশিয়াম ও ২.৭৯ কেজি ম্যাগনেসিয়াম ফিরিয়ে দেয়।
পাম অয়েল একটি বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ। রোপণের তিন থেকে সাড়ে তিন বছরের মধ্যেই এই উদ্ভিদের ফলন শুরু হয়। এই গাছ একটানা বানিজ্যিক ভিত্তিতে ৩০ থেকে ৩৫ বছর ফলন দেয়। এই গাছ থেকে সারা বছরব্যাপী ৮-১০টি কাঁদি বা ছরি আহরণ করা যায়। পাম অয়েল চাষ করে প্রতি বছর হেক্টর প্রতি ১০ থেকে ১৬ টন ভোজ্য তেল পাওয়া যায়। একই গাছে পুরুষ ও স্ত্রী ফুল থাকে এবং এগুলির মধ্যে বায়ু ও পোকামাকড় দ্বারা পরাগায়ন ঘটে।
মালয়েশিয়ায় একটি কাঁদির ওজন হয় ২০ থেকে ২৫ কেজি। কিন্তু বাংলাদেশে একটি কাঁদি বা ছরি ৪০ থেকে ৮০ কেজি পর্যন্ত ওজন হয়। যা বানিজ্যিকভাবে যে কোন ভোজ্যতেলের ফসল থেকে প্রাপ্ত তেল অপেক্ষা ৫০ গুন বেশি। পাম অয়েল গাছ পরিবেশ অনকূলীয় গুচ্ছমূল জাতীয় উদ্ভিদ। উপকূলীয় এলাকায় পাম অয়েল গাছ চাষ করলে মাটির ভাঙ্গন, মাটির ক্ষয়রোধ ও ঘূর্ণিঝড় প্রতিরোধ হবে এবং এর ফল সংগ্রহ করে তেল আহরণ সম্ভব। এই উদ্ভিদ অন্যান্য উদ্ভিদের চেয়ে ১০ গুন বেশি কার্বনডাইঅক্সাইড গ্রহণ করে এবং ১০ গুন বেশি অক্সিজেন ছাড়ে।
একটু পানিতে পাকা পাম ফল সিদ্ধ করে হাত দ্বারা চাপ দিলে রস বের হয়, সেই রসে পানি মিশ্রিত থাকে। এজন্য পানি মিশ্রিত তেল পাতিলে জ্বাল দিলে পানি বাস্প হয়ে চলে যায়। তারপর বোতল জাত করে রান্নার কাজে ব্যবহার করা যায়। এই তেল স্বাদযুক্ত এবং গন্ধহীন।
পাম অয়েল ফলকে প্রক্রিয়াজাত করে দু’ধরনের তেল পাওয়া যায়। ফলটির মাংসল অংশ থেকে পাম তেল আহরণ করা হয়, আর বীজ বা শাঁস থেকে পাওয়া যায় পাম কার্ণেল। প্রতিটি ফল থেকে ৯ ভাগ তেল ও ১ ভাগ পাম কার্ণেল পাওয়া যায়। সদ্য আহরিত পাম তেল বিটা ক্যারোটিনের সমৃদ্ধতম উৎস। পাম তেল সম্পৃক্ত উভয় প্রকারের ফ্যাটি এসিডের সুষম সমাহার ঘটায়। এছাড়া এতে ভিটামিন ‘ই’ এর পরিমাণ অধিক থাকায় এটি প্রাকৃতিকভাবেই একটি সুস্থিত তেল। পাম অয়েল খাদ্য ছাড়াও কসমেটিক্স, সাবান, ডিটারজেন্ট, গ্রিজ, মিল্ক পাউডার ইত্যাদিতে ব্যবহার করা যায়। হাতে তৈরি তেল দ্বারা ডিজেল ইঞ্জিন চালানো সম্ভব।
বিশ্বখ্যাত পুষ্টি বিজ্ঞানীদের দ্বারা পরিচালিত সমীক্ষায় প্রমানিত হয়েছে যে পাম তেলের বিশেষ স্বাস্থ্যপ্রদ গুণাবলী রয়েছে। এই তেল কোলেস্টরেল মুক্ত। পাম তেল খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করলে দেহে ক্ষতিকর কোলেস্টরেলর মাত্রা কমে যায়। পাম তেল রক্তের জমাট বাধা প্রবণতা হ্রাস করে, যার ফলশ্রুতিতে হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস পায়।
বাংলাদেশ সময় ১৬০৮, মার্চ ১১, ২০১১