ঢাকা, শনিবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৭ মে ২০২৫, ১৯ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

এই প্রজন্মের রবীন্দ্রনাথ

গ্রন্থনা: শেরিফ সায়ার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:০৪, মে ১২, ২০১১
এই প্রজন্মের রবীন্দ্রনাথ

নতুন প্রজন্মের কাছে রবীন্দ্রনাথ ধরা দিয়েছেন বহুভাবে। শিল্পের বিশাল ভাণ্ডারে রবীন্দ্রনাথকে কেউ ভালোবাসেন গানে, কেউ কবিতায়, কেউ নাটকে, কেউ উপন্যাস-গল্পে।

এই প্রজন্মের কয়েকজনকে প্রশ্ন করা হয়েছিল , তাদের নিজেদের রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে। তাঁরা উত্তর দিয়েছেন তাদের মতো করেই।

আকাশে পাতিয়া কান, শুনেছি শুনেছি তোমারই গান
রবি ঠাকুরের সাথে পরিচয়টা খুবই হয় বেরসিকভাবে। স্কুলের পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে। কবিতা, ছোটগল্প পড়ে পাতার পর পাতা উত্তর লেখা খুব রসাত্মক কিছু ছিল না কখনোই। পরীক্ষা এমন একটি বিষযুক্ত বিষয় যে রবিঠাকুরের সাথেও শত্রুতা হতে দেরি হলো না। অতএব ‘পড়িয়া আমরা (আমাদিগের মতো অনেকেই) প্রমাণ করিলাম আসলে আমরা কেহই রবিঠাকুর পড়ি নাই’।
পাঠ্যবই রবীন্দ্রনাথকে ছাড়েনি। তবে আমরা ছেড়েছিলাম পাঠ্যবইয়ের রবীন্দ্রনাথকে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সবুজ প্রান্তরে রবিকে আবার পাওয়া ‘শেষের কবিতা’ মলাটে। এখানেও বেশ একটা যুতসই পাঠকভাব এলো না। সাহিত্যের চোখে অপরাধী হলাম আবার। পছন্দ হলো না অমিত-লাবণ্যের প্রেম-পরিণয়। ‘ফ্যাশন’ আর ‘স্টাইল’-এর টানাহেঁচড়ায় নিজের মুখ আর মুখশ্রীর অবস্থাই বিতিকিচ্ছিরি।

এই অধমই পৌঁছে গেলো রবীন্দ্রনাথের দ্বারে। রকপ্রেমীর কাছে রবি এলেন দার্শনিকরূপে। ধীরে ধীরে এক-একটি গানের প্রতিটি লাইন একটু একটু করে আপন হতে থাকলো মনের ঠিক কেন্দ্রে। সামান্য বিরহবেলায় মনে আসে ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই চির দিন কেন পাই না’। ভালোবাসার মতো অলীক একটি বিষয়কে তিনি বললেন, ‘লোকে তবে করে কি সুখের তরে এমন দুঃখেরও আঁশ’...সত্যিই তো। এমন কি কেউ আছে যে ভালোবেসে কষ্ট পায়নি! এমনকি হয়তো ভরা ফাল্গুনে শত হাসি আনন্দের মাঝেও যখন একাকীত্ব ভর করে, সেই অনুভূতিটাও তিনি বললেন এভাবে, ‘কি জানি কিসের লাগি লাগি প্রাণ করে হায় হায়..’। সত্যিই তো মানুষের মাঝে অনেক পাওয়ার পরও ‘হায়’ বেদনা থেকেই যায়। যা মনে কড়া নাড়ে ঠিক সুখসময়ের পরপরই।

এমন কী আছে যা নিয়ে রবি লিখেননি। প্রশ্ন নিজের কাছেই। মনের যে কোণে প্রশ্ন সেখানেই উত্তর হয়ে আসেন রবি ঠাকুর আর তার গান, ছোটগল্প বা উপন্যাস। তাই আজ কোনো দ্বিধা ছাড়াই বলা যায় ‘আমি আকাশে পাতিয়া কান, শুনেছি শুনেছি তোমারই গান...আমি তোমারে সঁপেছি প্রাণ’।

ফারজানা রুম্পা, সাংস্কৃতিক সংগঠক

অশেষ পথিক
আজ সকালের আমন্ত্রণে আমি যে রাতের কাছে গেলাম তার নাম রবীন্দ্রনাথ। কারণ দেড়শ বছর আগের ২৫ বৈশাখের এক জাতক আমার পৃথিবীকে এমন অভিজ্ঞান দান করেছেন যে, রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে। হ্যাঁ, শিমুলপুরের বিনয় মুজমদার যেমন বলেন, রবীন্দ্র-জন্মের পর পৃথিবী আর পৃথিবী নেই। পৃথিবী এরপর থেকে রবীন্দ্রগ্রহ। এ কথাকে উন্মাদ-প্রলাপ বলে মনে হলেও দেখি আমার দেখার চোখটা পাল্টে দিয়েছেন জোড়াসাঁকোর এই ঠাকুর। তার দিগি¦দিক প্রভায় আমার ভেতরকার ঢেউগুলোও ভাঙছে দু ধারে, নিরূপায়।

কালরাত্রি, নাগিণী নিঃশ্বাস, ঝড়ো হাওয়া পেরিয়ে-মাড়িয়ে স্বপ্নভঙ্গ থেকে পৌঁছবো হয়তো বোধে। হয়তো বা পৌঁছবো না কোথাও। তাতেও খেদ নেই। পথ চাওয়াতেই যে আনন্দ।

অধ্যাপককবলিত রবীন্দ্রনাথ আমার কেউ নন। চারদিকে মঞ্চ আলো হয়। মূঢ়ের তালি পড়ে। বলে পক্ককেশ ভক্তবৃন্দ, ‘মহামহিম রবীন্দ্রনাথ, তাকে অতিক্রমের সাধ্য কারও নাই। ’ অথচ অতিক্রমের আনন্দগান তো তাঁরই। পথে চলে যেতে যেতে এমনকী নিজেকেই ছাড়িয়ে যেতে হবে। আর জানি না তো পথের শেষ কোথায়।

পিয়াস মজিদ, তরুণ কবি    

আমার চেতনায় রবীন্দ্রনাথ
সে বয়সে কোনো স্বপনচারিণীর দেখা না মিললেও দেখা মিলল পকেট সাইজের একখ- বাংলা ‘গীতাঞ্জলি’র, বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠদের কল্যাণে। তার ভেতরের প্রথম পাতায় রবীন্দ্রনাথের একটা ছবি। তিনি বসে আছেন শান্তিনিকেতনের একটা বাঁধানো বেদীতে। বেদীটির সাথে একটা স্তম্ভ, তাতে লেখা, ‘তিনি আমার আত্মার শান্তি’।

স্কুলের চৌকাঠ পেরিয়ে কলেজে পড়ার বয়সে ‘গল্পগুচ্ছ’র গল্পগুলো বারবার পড়ার আনন্দে আমাকে ভরিয়ে তুলল। রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ এলেই সেই ১৭-১৮ বছর বয়সে এক সহপাঠী বলতেন, ‘আমি ও সুরবালা একত্রে বউ বউ খেলিয়াছিÑ  এই গল্পটা আমি সাতাশ বার পড়ছি!’ একবার ক্লাসটেস্টের খাতা দেখে কলেজের বাংলা-শিক্ষক বললেন, এক ছেলে ‘রবীন্দ্রনাথ’ বানান ভুল লিখেছে। ও হৈমন্তীর যতই ভালো ব্যাখ্যা লিখুক ওরে আমি একের বেশি দিমু না!

পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে বাংলা একাডেমী রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি গীতাঞ্জলির পাশাপাশি বাংলা কবিতাগুলো সাজিয়ে একটা সংস্করণ প্রকাশ করে। সে-বই একটা কিনে দেখি প্রায় দশ বছর আগে যেসব কবিতা মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল নিজের অজান্তে তার অনেক কিছুই অবিকল মনে আছে। পাশাপাশি বাংলা ও ইংরেজি পড়তে গিয়ে মনে হলো, ইংরেজিটা যেন এখনকার আর বাংলাটা বুঝি পুরনো দিনের! তবে বিশ্বচরাচর আর মানবজীবনের আবেগ অনুভব ও বৈচিত্র্য নিয়ে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য ‘সুন্দর তুমি এসেছিলে আজ প্রাতে’ কিংবা ‘বন্দী, তোরে কে বেঁধেছে এমন কঠিন করে’ চিরায়ত, শাশ্বত।

আবু সিদ, চাকরিজীবী

আমার সুখ-দুঃখে রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথ হলেন একজন অসামান্য গীতিকার। তিনি সুরের যে অপার ভা-ার বাংলা সঙ্গীতে দিয়ে গেছেন সেজন্য বাঙালির তাঁর প্রতি চিরজীবন কৃতজ্ঞ থাকতে হবে। পৃথিবীতে এমন সুরকার ছিলেন কি, কিংবা একাধারে শিল্পের এতোগুলো শাখায় বিচরণ পৃথিবীর অন্য কোনো শিল্পী করেছেন কি? আমি জানি না। আমাদের ভাবের  এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে তিনি প্রবেশ করেননি। তাঁর প্রতিটি গানে রয়েছে আকুলতা, বেদনা, জীবনের কথা। ‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে, তাই হেরি তাই সকল খানে’। কী অসাধারণ গঠনশৈলী। তাঁর প্রতিটি গানের সুর আমাকে ছুঁয়ে যায়। আমার চেতনা মানেই তো সুখ-দুঃখমাখা জীবন। আর সে জীবনে রবীন্দ্রনাথ প্রতিটি প্রান্তে আছেন।

নাভিলা রহমান নদী, ছাত্রী, আইইউবি

নতুনের কাছে ছড়িয়ে যাক রবীন্দ্রনাথ
‘আমাদের ছোট নদী’ কবিতার মাধ্যমে শিশুকালে রবিঠাকুরের সাথে আমাদের পরিচয়। জানলাম, তিনি প্রথম বাঙালি হিসেবে নোবেল প্রাইজ জিতেছিলেন। তিনি আমাদের গর্বের স্মারক। কখনও ভাবিনি তিনি বাংলাদেশের না ভারতের, তিনি কি এ বাংলার না ওপার বাংলার। তিনি আমাদের সকল সৃষ্টিশীল চিন্তাধারার ধারক-বাহক-অনুপ্রেরণা। বর্তমান যুগ ফেসবুক আর ব্লগের। আমাদের প্রজন্ম কবিগুরুকে নিয়ে এসেছে ফেসবুক এবং ব্লগের জগতে। তাই এর মাধ্যমে আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের বহু না-জানা গল্প আমরা জানতে পারি তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে। বহু ছেলে-মেয়ে আছে যারা হয়তো জানতই না রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনটি কবে। কিন্তু আজ ফেসবুকের কল্যাণে জানতে পারছে তার সম্পর্কে। এগুলো তো আমাদের প্রজন্মকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে। রবীন্দ্রনাথ আরও অলংকৃত হবেন। ছড়িয়ে যাবেন সারা বিশ্বের নতুনদের মাঝে। রবীন্দ্রনাথ যেমন ধর্ম-কাল-জাতপাতের ঊর্ধ্বে ছিলেন, ঠিক তেমনি আমিও বলতে চাই, মানবতাই পৃথিবীর আসল ধর্ম। মনুষ্যত্বই মানুষের আসল জাত।  

তাশফী মাহমুদ, শিক্ষার্থী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকৃতির মাঝেই রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতিপ্রেমী ছিলেন। প্রকৃতির বুকে তিনি বার বার ফিরে গেছেন। গাছপালা-নদী-পাখি সব উঠে এসেছে তাঁর কবিতায়-গানে। তাঁর কবিতায় পড়েছি, ‘আজ বিকালে কোকিল ডাকে,/শুনে মনে লাগে/বাংলাদেশে ছিলেম যেন/তিনশো বছর আগে। /সে দিনের সে স্নিগ্ধ গভীর/গ্রামপথের মায়া/আমার চোখে ফেলেছে আজ/অশ্রুজলের ছায়া’।    

কী চমৎকার কবিতা। ঠিকই যেন চলে যাই গ্রামপথের মাঝে। রবীন্দ্রনাথ এমনই। যিনি চেতনার ভেতর ঢুকে যেতে পারেন। তাঁর সৃষ্টিশীলতা মানুষকে শত বছরেরও বেশি কাল বছর ধরে আনন্দ দিয়ে বেড়াচ্ছে, এ-ই বা কম কি! চেতনা তো তৈরি হয়েই আছে রবীন্দ্রনাথের জন্য। আমি মাঝে মাঝে নিজের ক্যামেরা নিয়ে প্রকৃতির বুকে যাই। মন চায় উপলব্ধি করি সব কিছু। ক্যামেরার ফ্রেমে আটকাতে চাই প্রকৃতিকে। কিন্তু সম্ভব হয়ে ওঠে না। ফ্রেমে কি আটকানো যায় প্রকৃতি? কিন্তু কী অসাধারণভাবে রবীন্দ্রনাথ তার কবিতায় প্রকৃতিকে আটকে দিয়েছেন। এমন কবি তো প্রকৃতিরই সৃষ্টি। তাই মনে হয় প্রকৃতির মাঝেই রবীন্দ্রনাথ। এই সবুজ হয়তো দেখার স্বাদ পেতাম না যদি না রবীন্দ্রনাথের কবিতায় মুগ্ধ না হতাম।

আশিকুর রহমান, ইন্টার্ন ডাক্তার, হলিফ্যামিলি হাসপাতাল

বাংলাদেশ সময় ২০৪০, মে ১২, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।