যখন চামচ ছিল না তখন মানুষ রান্নার সময় কি দিয়ে ভাত-তরকারি নাড়তো, খাবার খাওয়ার সময় ফক দিয়ে ভাত-তরকারি বাড়তো। যে সব দেশের মানুষ চামচ দিয়ে খাবার খায় তারা কী দিয়ে খাবার খেতো।
ধাতুর ব্যবহার শেখার আগে মানুষ এখনকার ব্যবহৃত ধাতব চামচ তৈরিই শেখেনি। তার আগে হয়তো গাছের ডালপালা, কাঠির টুকরা চামচরূপে ব্যবহৃত হয়ে থাকবে। পাথরের ব্যবহার আয়ত্ত করার পর মানুষ হয়তো পাথরখ- চামচরূপে ব্যবহার করেছে। প্রাচীন সভ্যতার বিভিন্ন নিদর্শন মানুষ মাটি খুঁড়ে আবিষ্কার করে। সেখানে মানুষ গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন উপকরণ, তৈজসপত্র খুঁজে পায়। তার মধ্যে চামচ বা চামচ আকৃতির জিনিসও রয়েছে।
প্রাচীন প্রস্তর যুগে খাওয়া-দাওয়ার কাজে ব্যবহৃত তৈজস হিসেবে চামচের ব্যবহার শুরু হয়। সম্ভবত প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষ গাছের খোলস এবং কাঠের পাতলা টুকরো চামচ হিসেবে ব্যবহার করতো। গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষায় চামচ বোঝাতে যে শব্দ দুটি ব্যবহৃত হয়েছে তা এসেছে ‘cochlea’ শব্দটি থেকে। এর অর্থ প্যাঁচানো বা সর্পিল আকৃতির শামুকের খোলস। এর থেকে বোঝা যায়, দক্ষিণ ইউরোপের সর্বত্র শামুক-ঝিনুকের খোলস বা খোলস আকৃতির কোনো জিনিস চামচ হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
এ্যাঙলো-সেক্সন (Anglo-Saxon) ভাষায় (উত্তর-পশ্চিম জার্মান অর্থাৎ উত্তর-পশ্চিম ইউরোপ থেকে আসা যে সব নৃগোষ্ঠী ইংল্যান্ডে বসতি স্থাপন করে তাদের ভাষা) চামচ বোঝাতে ব্যবহৃত হয় ‘Spon’ শব্দটি। এর অর্থ কাঠের পাতলা টুকরা বা গাছের চটা। এর থেকে ধারণা করা যায়, উত্তর ইউরোপেও চামচ হিসেবে এসব উপকরণ অর্থাৎ কাঠের টুকরো বা কোনো প্রাণীর খোলসই ব্যবহৃত হতো। এই খোলস এবং কাঠ ছাড়াও অতীতে আরও নানান উপকরণ দিয়ে চামচ তৈরি হতো। এর মধ্যে ছিল বিভিন্ন ধাতব পদার্থ যেমন- স্বর্ণ, রুপা, ব্রোঞ্জ, টিন ও সীসা মিশ্রিত পদার্থ ইত্যাদি।
এছাড়া হাতির দাঁত, হাড়, শিং এবং মাটি, চীনামাটি, ক্রিস্টাল (স্ফটিক) দিয়েও চামচ তৈরি হতো। এর থেকে ধারণা করা যায়, গাছের চটা, কাঠের টুকরা বা শামুকের খোলস ছাড়াও আরও নানান উপকরণ দিয়েও তৎকালে চামচ তৈরি হতো।
খ্র্রিস্টীয় প্রথম শতকে রোমানরা দুই ধরনের চামচ তৈরি করে। এ চামচ ছিল নকশাদার। এর একটি হলো ‘ligula’, যা স্যুপ এবং নরম খাবার খাওয়ার জন্য ব্যবহৃত হতো। এর সামনের দিকে ডিমের মতো অর্ধ-গোলাকার বাটির মতো এবং হাতলের শেষের দিকে কারুকাজ নকশা থাকতো। আরেক ধরনের চামচকে বলা হতো ‘cochleare’ যা ছিল ছোট আকৃতির। এর সামনের দিকটা ছিল গোলাকার বাটির মতো, পেছনে ছিল সরু ও চোখা হাতল। শক্ত খোলসযুক্ত মাছ, শামুক, ঝিনুক, কাঁকড়া, চিংড়ি এবং ডিম খাওয়ার জন্য এ চামচ ব্যবহার করা হতো। ইংরেজদের প্রথম দিকের চামচের মডেল ছিল অনেকটা এরকমই। খ্রিস্টীয় ৪৩ থেকে ৪১০ সাল পর্যন্ত ব্রিটেনে রোমানদের বসবাস ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণেই হয়তো এমনটা হয়েছিল। ইংরেজরা রোমানদের তৈরি চামচ ব্যবহার করতো, সম্ভবত তারা রোমান চামচ অনুসরণ করে চামচ তৈরি করেছিল।
মধ্যযুগেও সাধারণত কাঠ বা শিং দিয়ে চামচ তৈরি হতো। খাবার পরিবেশন করা এবং খাবার গ্রহণের জন্য এই চামচই দেওয়া হতো। রাজ পরিবার ব্যবহার করতো সোনার চামচ। আর ধনী পরিবার ব্যবহার করতো রুপার চামচ।
চৌদ্দ শতকের শুরুতে চামচ তৈরি হতো টিন ও লোহা মিশ্রিত পদার্থ, টিন ও সীসা মিশ্রিত পদার্থ কিংবা পিতল দিয়ে। এছাড়াও সে সময় আরও নানান পদার্থ দিয়ে চামচ তৈরি হতো। এগুলোর মধ্যে আবার নানান নকশা করা হতো। এর মধ্যে টিন ও সীসা মিশ্রিত পদার্থ দিয়ে তৈরি চামচই সাধারণ মানুষ বেশি ব্যবহার করতো। কেননা, এই চামচই সাধারণ মানুষের সামর্থ্যরে মধ্যে ছিল।
প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস থাক। আধুনিক সভ্যতার কথা বলি। বর্তমান সময়ে বিশ্ব জুড়ে রয়েছে চামচের ব্যবহার। মানুষ এখন বেশি ব্যবহার করছে ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরি চামচ। এছাড়া প্লাস্টিকের চামচও ব্যবহৃত হচ্ছে। আরও নানান পদার্থের তৈরি সৌখিন চামচ বাজারে রয়েছে। উন্নত বিশ্বে বিশেষ করে ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, রাশিয়া ইত্যাদি দেশের মানুষ খাবার পরিবেশন তো বটেই খাবার গ্রহণও করে চামচ দিয়ে। হাত দিয়ে খাওয়া তাদের কাছে অসভ্যতা।
আর আমরা বাঙালিরা হাত দিয়ে ভাত খাই। হাত দিয়ে ভাত না খেলে আমাদের পেট ভরলেও মন ভরে না। আমাদের দেশের শহরে-বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে সব জায়গাতেই ধাতব চামচ পাওয়া যায়। আজকাল ধনী-গরিব সবাই ব্যবহার করে ধাতব চামচ। এর মধ্যে প্রধানত স্টিলের চামচই বেশি ব্যবহৃত হয়। এক সময় কাঁসা-পিতলের চামচের ব্যবহারও ব্যাপক ছিল।
কিন্তু যখন ধাতব চামচ বিশেষত স্টিলের চামচের প্রচলন ছিল না তখন আমাদের দেশের মানুষ কেমন চামচ ব্যবহার করতো? এর উত্তর, প্রধানত কাঠের চামচ। তাছাড়া চামচের বিকল্প হিসেবে মানুষ বাঁশ, কাঠ ও অন্যান্য উপকরণ দিয়ে চামচ আকৃতির কিছু একটা তৈরি করে নিতো। বছর ত্রিশ আগেও এদেশের গ্রামীণ পরিবারে কাঁসা-পিতলের চামচের ব্যবহার বেশি ছিল। অবশ্য যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল, শুধু তাদের ঘরে কাঁসা-পিতলের চামচ দেখা যেতো। এর পাশাপাশি সাধারণ পরিবারে লোকজ উপকরণ দিয়ে তৈরি চামচ ও চামচসদৃশ বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহৃত হতো। কাঁসা-পিতলের চামচ বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে বের করা হতো। আর দরিদ্র পরিবারে শুধু লোকজ উপকরণ ব্যবহার করে তৈরি চামচ বা চামচসদৃশ জিনিস দিয়েই চামচের কাজ চালানো হতো। এর মধ্যে ছিল নারকেলের মালা, বাঁশের চটা, নাকুর, হাতা, উড়ন, ঝিনুক ইত্যাদি।
কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয় নানান রকমের চামচ। কোনোটি ভাত বাড়ার জন্য, কোনোটি তরকারি বাড়ার জন্য। আকৃতি ও গঠনের দিক থেকে দেখলে একেকটি একেক রকম। এর স্থানীয় একটি নাম হলো হাতা। কোথাও আবার নাড়ুনি নামে পরিচিত। কাঠের তৈরি এসব চামচে নানান নকশা করা হয়। কাঠ খোদাই করে এসব চামচ তৈরি করা হয়।
নারকেলের মালা দিয়ে একধরনের চামচ তৈরি হতো। একটা নারকেল ঠিক মাঝখানে ফাটালে এর দুটি অংশ বের হয়। এর একটিতে দুটি ফুটো করে এর মধ্যে একটি বাঁশের কাঠি হাতল হিসেবে লাগিয়ে দেওয়া হয়। একে বলা হয় উড়ন। কোথাও আবার বলা হয় ডাব্বুয়া। ডাব বা নারকেল মালা দিয়ে তৈরি বলে এর এ ধরনের নাম। এই জিনিসটা সাধারণত ডাল পরিবেশন এবং তরল খাবার পরিবেশনের কাজে ব্যবহৃত হতো।
বাঁশ বা কাঠের তৈরি লম্বা লাঠির মতো একটি জিনিস, চেঁছে এটি গোল করা হয়। এর নাম নাকুর। ভাত রান্নার সময় নেড়ে দেওয়ার জন্য এটি ব্যবহার করা হয়। এটা চামচের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হতো। গ্রামে-গঞ্জে এখনো নাকুরের ব্যবহার আছে।
বাঁশের চটা কেটে তরকারি নাড়ার এক ধরনের জিনিস তৈরি হতো। একে বলা হয় ভাজার কাঁটা। সাধারণত ভাজি নাড়ার জন্য কিংবা মাছ, ডিম প্রভৃতি ভাজার সময় উল্টে দেওয়ার জন্য এটি ব্যবহৃত হয়। ঘরোয়া পরিবেশে খাবার পরিবেশনে বিশেষ করে ভাজি জাতীয় তরকারি পরিবেশনের জন্যও এটি এখনো ব্যবহার করা হয়। এটি অনেকটা চামচসদৃশ জিনিস, দেখতে চ্যাপ্টা আকৃতির।
প্রকৃতি থেকে পাওয়া যায় ঝিনুক। এক সময় ঝিনুকের খোলসও চামচের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এই বছর ত্রিশ আগেও গ্রাম-বাংলায় খাবার পরিবেশনে ঝিনুকের খোলসের ব্যবহার ছিল। প্রকৃতি থেকে বিনে পয়সায় পাওয়া যেতো বলে দরিদ্র পরিবারে এর ব্যবহার বেশি ছিল। বিশেষ করে লবণ ও দই পরিবেশনে ঝিনুকের খোলস চামচ হিসেবে ব্যবহৃত হতো বেশি।
বাংলাদেশ সময় ১৩১০, এপ্রিল ১৫, ২০১১