ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

বগুড়ার দই তৈরির যাদুকরি কৌশল!

বেলাল হোসেন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮১৯ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০১৫
বগুড়ার দই তৈরির যাদুকরি কৌশল! ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বগুড়া: কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দইওয়ালা’ গল্পের দই নেবেন গো দই, ভালো দই-এমন হাঁক ডাক ছেড়ে এককালে গ্রাম বাঙলার মেঠোপথ ধরে বা হাট-বাজারে ফেরি করে বিক্রি হতো মিষ্টি দই।

এখন আর সে দৃশ্য আর চোখে পড়ে না।

দই এখন জায়গা করে নিয়েছে শহরের আলো ঝলমলে নামিদামি দোকানে।

গুণে, মানে ও স্বাদের কারণে বগুড়ার শেরপুর উপজেলার দইয়ের সুখ্যাতি দেশজুড়ে।

প্রবাদ রয়েছে, দই মিষ্টি ক্ষিরসা, রাজা বাদশা শেরশাহ, মসজিদ মন্দির মূর্চাঘুর, এসব মিলেই শেরপুর।

এই জেলায় কেউ বেড়াতে এলে দইয়ের স্বাদ আস্বাদন করা যেন চাই-ই চাই। আবার এখান থেকে বাইরে গেলেও তার সঙ্গী হয় বগুড়ার (শেরপুরের) দই।

এছাড়া ঈদ, পূজা, বিয়ে, জন্মদিন, আকিকা, হালখাতাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের দই যেন অত্যাবশ্যকীয় অনুষঙ্গ। এ অঞ্চলে অতিথি আপ্যায়নের তালিকায় দইয়ের নাম থাকাটা ঐতিহ্যের অংশও বটে।

এখানকার উৎপাদিত দই স্বাদে মানে অনন্য হওয়ায় শেরপুর আর দই শব্দটি যেন একে অন্যের সমার্থক হয়ে উঠেছে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এখানে বেড়েছে দইয়ের চাহিদা, জনপ্রিয়তা, উৎপাদন ও বিপণন। বর্তমানে দই তৈরির প্রক্রিয়ায়ও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।

প্রাগৈতিহাসিক যুগে ঘোষ সম্প্রদায়ের লোকজন শেরপুর পৌরশহরের ঘোষপাড়ায় এই শিল্পের সূচনা করেন। ঘোষেদের সেই সুস্বাদু দই তৈরির ফরমুলা বা প্রস্তুত প্রণালী অনেকের হাতেই চলে গেছে। তবে তৈরি পদ্ধতির কোথায় যেন ঘাটতি রয়ে গেছে। এজন্য এতোদিনেও এখানকার দইয়ের স্বাদ ও সুনামে চির ধরাতে পারেনি কেউ।  

বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য দই তৈরির পদ্ধতি জানিয়েছেন শেরপুরের দই কারিগররা।

তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী দই তৈরির জন্য প্রয়োজন: দুধ, চিনি, স্যাকারিন (পাতলা দই তৈরির ক্ষেত্রে), পানি, টিন, বালতি, মগ, কড়াই, ড্রাম, নাড়ুনি, চুলা, দক্ষ কারিগর, তেঁতুল গাছের লাকড়ি, বাঁশের তৈরি ছাউনি বা ছাতা ও দই রাখার জন্য বিভিন্ন ধরনের মাটির পাত্র।

মিষ্টি দই তৈরি পদ্ধতি: দই তৈরির পদ্ধতি সম্পর্কে শেরপুর পৌরশহরের ঘোষ পাড়ার মৃত গোপেশ্বরী ঘোষের ছেলে বংশীয় পেশার অধিকারী নিমাই ঘোষ বাংলানিউজকে জানান, প্রথমে ভালো মানের দুধ কিনতে হবে। এরপর সেই দুধ কড়াই বা ড্রামে ঢালার আগে ১০০ কেজি দুধের বিপরীতে ১০ কেজি পানি ফুটিয়ে নিতে হবে।

তারপর ফুটন্ত সেই পানির মধ্যে দুধ দিয়ে একটানা কমপক্ষে আড়াই ঘণ্টা জ্বাল দিতে হবে। পাশাপাশি অনেকটা বিরতিহীনভাবে সেই দুধ নাড়তে হবে। এসময়ের মধ্যে সম্পূর্ণ পানি ও দুধের একটি অংশ জলীয়বাষ্প হয়ে উড়ে যাবে।

এরপর জ্বলন্ত চুলায় ফুটন্ত সেই ১০০ কেজি দুধের মধ্যে ২০ থেকে ২২ কেজি চিনি ঢেলে দিয়ে আবারও জ্বাল চালিয়ে নিতে হবে। মাত্র ১০/১৫ মিনিটের মধ্যে সেই চিনি সম্পূর্ণ গলে দুধের সঙ্গে মিশে যাবে।

এ পর্যায়ে জ্বলন্ত কড়াই বা ড্রাম থেকে সেই দুধ বালতিতে ভরে মগে করে চুলার চারপাশে আগেই সারিবদ্ধভাবে রাখা মাটির বাসনে ঢালতে হবে। তবে চাহিদা অনুযায়ী কাপ, বাটি ও ছোট আকারের কলসিতেও দই ভরা হয়। এসব প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে প্রথম ধাপের কাজ শেষ হয়।

তিনি আরো জানান, দ্বিতীয় ধাপের শুরুতেই ওই পাত্রগুলো জ্বলন্ত চুলার পাশের রেখে ছাউনি বা ছাতা দিয়ে ঢেকে রাখতে হয়। এদিকে ফুটন্ত দুধ পাত্রে ভরার আগে সেই কড়াই থেকে উৎপাদন চাহিদা অনুযায়ী ১০/১২ কেজি (একটু কমবেশি হতে পারে) দুধ আলাদা পাত্রে রাখা হয়।

তবে মাঝে মধ্যেই ছাউনি উঠিয়ে দেখতে হয় যে পাত্রে দই ঠিকমতো জমছে কী না। আর দই সঠিকভাবে পাত্রে জমানোর ক্ষেত্রে তাপমাত্রা একটি বড় বিষয়। এসময় খুব  বেশি গরম হলেও সমস্যা, আবার ঠাণ্ডা হলে তো দই জমবেই না। তাই তাপমাত্রা নির্ধারণের কাজটি সাধারণত দক্ষ কারিগররাই ঠিক করেন।

এভাবে দুই ঘণ্টা অতিবাহিত হওয়ার পর আলাদাভাবে রাখা ফুটন্ত সেই দুধের মধ্যে তিল পরিমাণ বীজ বা বেছন দই (আগের দিনে তৈরি দই) নিয়ে ভালোভাবে মিশিয়ে নিতে হয়। এরপর ছাউনি উঁচু করে রেখে পাত্রে আগে রাখা দুধের পরিমাণ বুঝে সেই বীজ মেশানো দুধ প্রতিটি পাত্রে কমবেশি করে দিয়ে আবারও ঢেকে দিতে হয়।

এরপর থেকে টানা ১০/১২ ঘণ্টা ছাউনি বা ছাতা দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। তারপর ছাউনি উঠিয়ে সেই দইয়ের পাত্রগুলো বের করা আনা হয়। আর এভাবেই তৈরি হয় অত্যন্ত সুস্বাদু মিষ্টি দই। যা সঙ্গে সঙ্গে শো-রুম ও বিভিন্ন পাইকারের মাধ্যমে বাজারজাত করা হয়।

নিমাই ঘোষ, লিটন ঘোষসহ একাধিক দই উৎপাদনকারী বাংলানিউজকে জানান, পাতলা দই তৈরির ক্ষেত্রে একই পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়। কেবল চিনির পরিবর্তে একই পরিমাণ দুধের মধ্যে দুই তোলা পরিমাণ স্যাকারিন ব্যবহার করতে হয়।

তাদের দাবি, এ উপজেলার মতো এতো সুস্বাদু ও মানসম্পন্ন দই দেশের কোথাও তৈরি হয় না। কেননা এখানকার আবহাওয়া দই তৈরির জন্য অত্যন্ত উৎকৃষ্ট। পানিও বেশ সুস্বাদু। সবমিলে কারগরি দক্ষতা ও তাদের নিপুণ হাতের যাদুকরি ছোঁয়ায় তৈরি হয় বগুড়ার (শেরপুরের) মিষ্টি দই।

বাংলাদেশ সময়: ০৮১০ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০১৫
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।