কোন বাধাই দমিয়ে রাখতে পারেনি ফাল্গুনীকে। পঙ্গু দু’হাত নিয়েই প্রবল ইচ্ছাশক্তির জোরে অংশ নিলেন এবারের এসএসসি পরীক্ষায়।
পটুয়াখালীর গলাচিপা পৌর শহরের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বটতলা এলাকার দরিদ্র জগদীশ চন্দ্র সাহা ও ভারতী সাহা দম্পতির মেয়ে ফাল্গুনী চার বোনের মধ্যে তৃতীয়। বাবা জগদীশ চন্দ্র সাহা একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। সীমিত রোজগার দিয়ে ৬ জনের সংসারে যেন তাল মেলাতে পারছিলেন না তিনি। ছোটবেলা থেকেই তাঁর অন্য তিন মেয়েদের চেয়ে ফাল্গুনী একটু আলাদা হওয়ায় বাবার স্বপ্ন ছিল তাকে ঘিরে। অভাবের তাড়নায় অন্য মেয়েদের পড়ালেখা চুকিয়ে দিলেও ফাল্গুনীর বেলায় ছিল ভিন্নরূপ। হঠাৎ এক ট্র্যাজেডি ফাল্গুনী ও তার বাবার স্বপ্নকে ম্লান করে দেয়।
ঘটনাটা ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি’র দিকে। ফাল্গুনী তখন মাত্র দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ছে। সে সময়ের এক বিকেলে পাশের বাড়ির ছাদে সমবয়সীদের সাথে খেলতে গিয়ে বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে তার দু’হাতের অর্ধেক অংশই ঝলসে যায়।
দেশের চিকিৎসা কাজে দিচ্ছিল না। তাই ফাল্গুনীকে নিয়ে যাওয়া হয় ভারতে। সেখানে কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলেও চিকিৎসকদের পরামর্শে তার দুটি হাত কেটে ফেলা হয়। এদিকে চিকিৎসার খরচ টানতে গিয়ে ফাল্গুনীর বাবা জগদীশ সাহা সর্বস্ব খুইয়েছেন। মা ভারতী সাহারও চিন্তার শেষ নেই। মেয়ের নিশ্চয় পড়াশোনাটা আর হলো না।
এদিকে মায়ের চিন্তার দিকে খুব একটা মন নেই ফাল্গুনীর। সে অন্যকে দেখে। তার মনে নানান প্রশ্ন। হাত ছাড়া লেখা যাবে না? পৃথিবীতে কিছুই তো অসম্ভব না। তবে এটা কেনো অসম্ভব হবে?
তবে ফাল্গুনীর কলম দেখলে খারাপ লাগতো। মন খারাপ হয়ে যেতো। এই মন খারাপের সময় ফাল্গুনীর জেঠুমণী মাঝে মাঝে বলতো, একটু চেষ্টা করে দেখতো লিখতে পারিস্ কিনা!
ফাল্গুনী একদিন সাহস করে কলমকে কামড় দিয়ে ধরলো। শুরু হলো চেষ্টা। আবার একদিন কাটা হাতের অংশ দিয়ে কলম ধরে লেখার চেষ্টা শুরু করলো। এভাবে একদিন-দুইদিন-তিনদিন। ব্যাস, হয়ে গেলো। কয়েক মাস পর ঠিকই লিখতে শুরু করলো ফাল্গুনী।
পঙ্গুত্বই পরাজয় বরণ করলো ফাল্গুনীর কাছে। আবার শুরু হলো স্কুলে যাওয়া।
পঞ্চম শ্রেণীতে বৃত্তি পাওয়া। ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভালো ফলাফল নিয়ে গলাচিপা মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া। এবং সর্বশেষ এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ নিয়ে সকলকে তাক লাগিয়ে দিলো ফাল্গুনী। পটুয়াখালীর উপকূলীয় এলাকায় ইচ্ছে শক্তির এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করায় ফাল্গুনীকে প্রায় প্রতিদিনই গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে তার সফলতার নেপথ্যের ইচ্ছে শক্তির কথা বলতে হচ্ছে।
ফাল্গুনীকে দেখলে সত্যিই মনে হয়, মানুষ চাইলে সবই পারে!
ফাল্গুনীর বাবা জগদীশ চন্দ্র সাহা বলেন, সংসারের প্রতিদিনের খরচ জোগাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। এখন মেয়ের উচ্চশিক্ষার ব্যয় কীভাবে বহন করবেন তা নিয়ে তিনি দুশ্চিন্তায় আছেন। অন্যদিকে গলাচিপা মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ শাহআলম জানান, ‘ওর সাফল্যে আমরা গর্বিত। আমরা বিশ্বাস করি আত্মবিশ্বাসী ফাল্গুনী শত বাধা পেরিয়ে তার লক্ষ্যে পৌঁছবেই’।
তবে ফাল্গুনী এতো চিন্তা করছে না। সে এখন ভাবছে ভবিষ্যতে উচ্চ শিক্ষা সম্পন্ন করে একজন সরকারী উচ্চ পদস্থ প্রশানিক কর্মকর্তা কীভাবে হওয়া যায়।
ফাল্গুনীর ভাষাতেই, আমাকে অনেক এগিয়ে যেতে হবে। অনেক অনেক এগিয়ে যেতে হবে। সব দুঃখকে ছাপিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৫, মে ১৯, ২০১১