চলে গেলেন বরেণ্য বাকশিল্পী, সংবাদপাঠক এবং ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের শব্দসেনা দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ না দিলেও যৌবনে ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক শিল্পী সংঘে কাজ শুরু করেছিলেন।
জন্মসূত্রে পশ্চিম বাংলার সন্তান হলেও পেশার তাগিদে ঘটনাপ্রবাহে যুক্ত হয়ে পড়লেন বাঙালির নিজের রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই তার কণ্ঠস্বর ইতিহাস রচনার দলিল হয়ে উঠল।
সংস্কৃত ভাষায় রচিত মহাকাব্য মহাভারতে কৌরব-পান্ডবদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে যুদ্ধের প্রতিটি মুহূর্তের ধারাভাষ্য দিতেন সঞ্জয়। বলা হয়, এই ধারাভাষ্য এতটাই জীবন্ত ছিল যে, অন্ধ ধ্রতরাষ্ট্র যুদ্ধের ভয়বাহতায় বার বার শিউরে উঠতেন যন্ত্রণায়।
একাত্তরের রণাঙ্গনে তার প্রত্যক্ষ উপস্থিতি ছিল না ঠিকই, কিন্তু প্রণবেশ সেনের গ্রন্থনায় রাত সাড়ে ১০টায় আকাশবাণী কলকাতার সংবাদ পরিক্রমায় সেই উদাত্ত কণ্ঠ ‘আকাশবাণী কলকাতা, খবর পড়ছি দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়...’ বাঙলিকে নিয়ে যেত পাক-হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মাতৃভূমিকে রক্ষার লড়াইয়ের রণাঙ্গনে।
এই সময়টুকুতে যুদ্ধের সংবাদে আবালবৃদ্ধবনিতারা মনে করতেন, মুক্তিযোদ্ধাদের মতো তারাও সম্মুখযুদ্ধে নেমেছেন রাইফেলের বদলে দেবদুলালের কণ্ঠকে হাতিয়ার করে।
দেবদুলাল তার কণ্ঠস্বরে পৌঁছে যেতেন শুধু কলকাতায় নয়, যুদ্ধরত মুক্তিসেনার কাছে, পাবনায়, খুলনায়। সেই শব্দতরঙ্গ কখন যেন দেশভাগের জ্বালাকে মুছিয়ে দিয়ে পশ্চিমবাংলাকে আবার পূর্ববাংলার সঙ্গে একাকার করে দিত।
এভাবেই শব্দকে কণ্ঠের জাদুতে মিশিয়ে তিনি হয়ে উঠলেন মুক্তিযুদ্ধের শব্দসেনা। হয়ে উঠলেন বাঙালির এক প্রেরণা-কণ্ঠ।
শৈশবে তার রেডিওতে খবর পড়া শুনে তাকে অনুকরণ করা হয়ে গেল আমার খেলা। তখনও কলকাতায় টেলিভিশন আসেনি। পরে যখন এল অপেক্ষা করছিলাম কবে তিনি আসবেন টেলিভিশন খবর পড়তে। এলেন কিন্তু রেডিওর মতো আবেদন পাওয়া গেল না।
বছর তিনিক আগে বাংলাদেশের বিজয় দিবস উপলক্ষে তার সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য গেলাম দক্ষিণ কলকাতার শবরী অ্যাপার্টমেন্টে। স্ত্রী ছেলে আর মেয়ে নিয়ে থাকেন তিনি। অবসর নিয়েছেন রেডিও থেকে।
জানতে চাইলাম, টিভিতে আর খবর পড়লেন না কেন?
হেসে বললেন, ‘দু দিন খবর পড়েই বুঝলাম, ওটা আমার কাজ কাজ নয়। বুঝলে, ওতে গ্লামার লাগে, আর কী যেন বলে, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ। ওসব আমার নেই। ’
‘বাংলাদেশের মানুষ কেমন আছে? বঙ্গবন্ধুকে যারা মেরেছিল তাদের কী হলো?’ জানতে চাইলেন দেবদুলাল।
তারপর নিজেই বললেন, ‘দেশ স্বাধীন হবার পর গেছিলাম। ’
থামিয়ে দিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোন দেশ?
রাগতকণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘বাংলাদেশ। ’ আবার হেসে বললেন, ‘ওটা তো আমারও দেশ। ’
‘পূর্বাণী হোটেলে সংবর্ধনা চলছিল। মঞ্চে বঙ্গবন্ধু। আমি পেছনে বসার জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ দেখি একজন এসে আমায় বলল, স্যার আপনাকে মঞ্চে ডাকছেন। অত দূর থেকে দেখেই আমায় ডেকে নিয়ে কাছে বসালেন। বড়মাপের মানুষ ছিলেন তিনি। ’ বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলছিলেন তিনি।
কলকাতার একাত্তরের সে সময়ের স্মৃতি শুনতে চাইলাম। বললেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ তখন শেষের দিকে। কলকাতায় ‘ব্ল্যাক আউট’। সন্ধ্যা হলে পাকিস্তানি বোমারু বিমানের ভয়ে রাস্তার ল্যাম্প পোস্টের আলো কালো কাগজ দিয়ে ঢাকা থাকত।
‘একদিন রাতে আকাশবাণী থেকে বের হচ্ছি, রাত তখন ১২টা। ইডেন গার্ডেনের পাশ দিয়ে হেঁটে পার্কস্ট্রিট গিয়ে বাস ধরব। স্টুডিওর বাইরে এসে হাঁটা শুরু করেছি। খেয়াল করলাম ফাঁকা রাস্তায় আমার পেছনে কে যেন আসছে।
‘পেছনে ঘুরতেই দেখলাম একজন রোগা ছেলে। গায়ে ছেঁড়া জামা। পরনে লুঙ্গি। মুখে একগাল দাড়ি। অবিন্যস্ত বড় চুল। তবে চোখ দুটো কেমন জ্বলজ্বল করছে।
‘আমি দাঁড়াতে সেও দাঁড়িয়ে পড়ল। কিছু বলল না। আমি আবার হাঁটা শুরু করলাম। সেও আমার পিছু নিলো। ভাবলাম, কে? আইএসআইর লোক নয় তো!
‘সাহস করে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললাম, কে তুমি? আমার পিছন পিছন আসছো কেন?
‘ছেলেটা আমার কথা শুনে ততক্ষণে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ছুটে এসে আমার পা জড়িয়ে ধরে বললো, ‘ভয় পাইয়েন না। আমি সালমান। মুক্তিযোদ্ধা। আপনাকে দেখতে এসেছি। কাল আমি যুদ্ধে যাব। আপনি আমারে দোয়া করেন, যেন খানসেনাদের দেশ থিকা তাড়াইতে পারি। ’ উঠে দাঁড়াল সালমান। তারপর এক দৌড়ে অন্ধকারে কোথায় যেন হারিয়ে গেল।
‘জানি না সালমান এখন কোথায়? আদৌ বেঁচে আছে কিনা।
‘আমার জীবনের সেরা সম্মান, না পদ্মশ্রী নয়, সালমানের শুভেচ্ছা। আজও ওর কথা আমার কানে বাজে, আমি সালমান। মুক্তিযোদ্ধা...। ’
বাংলাদেশ সময় ২০০৫ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০১১