ঢাকা, শনিবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৭ মে ২০২৫, ১৯ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

মাইনাস টু নয়, মাইনাস ফোর: মাহী বি চৌধুরী

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯:৪৩, জুন ১৯, ২০১১
মাইনাস টু নয়, মাইনাস ফোর: মাহী বি চৌধুরী

আলোচিত তরুণ রাজনীতিবিদ মাহী বি চৌধুরী নতুন প্রজন্মের কাছে এক অন্য মানুষ। তরুণ প্রজন্মকে রাজনীতিতে উৎসাহিত করতে তিনি বহুদিন ধরে কাজ করছেন।

নিজেও উপস্থিত থাকেন রাজনীতির মাঠে। বারিধারার বাসভবনে নিজের রাজনৈতিক জীবন ও স্বপ্ন নিয়ে তিনি সরাসরি কথা বলেছেন বাংলানিউজের সঙ্গে। এ আলোচনার তিনি একপর্যায়ে তরুণদের প্রতি বলে ওঠেন, রাজনীতিকে ঘৃণা করো না।

তাঁর সাক্ষাৎকারের প্রথম অংশের পর আজ প্রকাশিত হলো দ্বিতীয় এবং শেষ অংশ।

সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন শেরিফ আল সায়ার।

আপনি বলছেন রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন সহজ নয়। কিন্তু তারপরও পরিবর্তন তো আনতে হবে। সে বিষয়ে কিছু বলুন।

একদম মাঠ পর্যায়ে পরিবর্তন করতে হলে আপনাকে তিউনিশিয়া হতে হবে। ইজিপ্ট হতে হবে। শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মকেই বিপ্লব করে সামনে এগিয়ে আসতে হবে।

তিউনিশিয়া, ইজিপ্টের নতুন প্রজন্ম যদি ফেসবুক ব্যবহার করে বিপ্লব ঘটাতে পারে তাহলে আমাদের দেশে কেনো সম্ভব না?

আমরা চাই নতুন প্রজন্ম রাজনীতিতে আসুক। কাজ করুক। যারা আন্দোলন করতে চায় না। ঝামেলাতে যেতে চায় না। কিন্তু মনে মনে ঠিকই পরিবর্তন চায়। তাদেরও আমরা উৎসাহিত করি অন্তত নিজ জায়গা থেকেও যাতে প্রতিবাদ জানায়।

আপনি বলতে চাচ্ছেন নতুন প্রজন্মকেই এগিয়ে আসতে হবে। কিন্তু তারা রাজনীতিতে সরাসরি জড়াবে বলে কি আপনি মনে করেন?

জড়াতেই হবে। নিজের অস্তিত্বের জন্য এবং দায়িত্ববোধ থেকেই জড়াতে হবে।

ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখবেন আমরা বিশ বছরের চক্রে আটকে গেছি। ৫২-তে তরুণরা তাদের দায়িত্ব পালন করেছে। তারা আমাদেরকে ভাষা দিয়েছে।

বিশ বছর পর আবার ৭১-এর প্রজন্মও তাদের দায়িত্ব পালন করেছে। তারা আমাদের একটা রাষ্ট্র দিয়েছে। আবার বিশ বছর পর ৯১-এর প্রজন্ম একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র দিয়েছে।

১৯৯১ - ২০১১। ব্যর্থতার বিশ বছর পার হয়ে যাচ্ছে। এটা এ প্রজন্মের দায়িত্ব। এ ব্যর্থতার সমাধান দেওয়া খালেদা জিয়া বা শেখ হাসিনার দায়িত্ব না। এটা আমাদের, নতুন প্রজন্মের দায়িত্ব। আপনাদের দায়িত্ব। নতুন প্রজন্মের প্রতিটি ছেলে-মেয়ের দায়িত্ব। এটা দেশের প্রতি এ প্রজন্মের দায়িত্ব।

আগের প্রজন্মের রাজনীতির প্রতি আগ্রহ ছিল কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম রাজনীতির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে কেন?

৭১-এ আমরা সবাই মিলে এক ছিলাম। কিন্তু স্বাধীনতার পর বিভক্তির রাজনীতি আমাদের সবাইকে বিভক্ত করে ফেলেছে। আমরা কিন্তু স্বাধীন রাষ্ট্রে রাজনীতির ধরণটা পাল্টাতে পারিনি।

৬৬-তে আমরা মাঠে স্লোগান দিয়েছি- ‘জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো’। আমরা ২০১১ সালে এসেও এ স্লোগান দেই। আমরা এখনও বলি, ‘দিয়েছি-তো রক্ত আরও দেবো রক্ত’।

কিন্তু কেন? আমি স্বাধীন দেশে কেন রক্ত দেবো? স্বাধীন দেশে আমি দেব মেধা আর জ্ঞান। রক্ত কেন দেবো? এটাই আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। সুতরাং রাজনীতি কিন্তু কেউ বদলাতে পারেনি। বিভক্তির রাজনীতি বরং আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। যুগ পাল্টেছে। কিন্তু রাজনীতির ধরণটা কিন্তু যুগের সঙ্গে পাল্টায়নি। তাই বর্তমান প্রজন্ম আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।

আপনি বিভক্তির কথা বলছেন। এ বিভক্তির রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে কি করতে হবে?

এ বিভক্তির রাজনীতি থেকে বের হতে হলে নতুন প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে। এ বিভক্তির শৃঙ্খল তাদেরই ভাঙতে হবে। রাজনীতিতে প্রতিহিংসা বন্ধ করতে হবে। শ্রদ্ধার রাজনীতি আনতে হবে। আমি বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসি। কিন্তু জিয়াউর রহমানকে ভালোবাসি না। ভালো কথা। কিন্তু তাই বলে আমি কেন জিয়াউর রহমানকে গালি দেবো, কুৎসা রটাবো? কিংবা বঙ্গবন্ধুকেই বা কেন গালি দেবো?

নতুন প্রজন্মের উচিত কারো বিরুদ্ধে না যাওয়া। শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধেও কথা বলার অধিকার আমাদের নেই। কারণ এ দু নেত্রী তাদের দায়িত্ব ৯১-তে পালন করেছেন। তারা দেশকে গণতন্ত্র দিয়েছেন। হ্যাঁ, এখন তাদের ব্যর্থতার প্রসঙ্গ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু সেটা আর কতদিন চলবে? ১৫ বছর তো এগুলো নিয়েই বিতর্ক চলছে।

এখন নতুন প্রজন্মের বলা উচিত, আপনাদের দায়িত্ব এখন শেষ। আমরা স্বসম্মানে আপনাদের বিদায় জানাতে চাই। এবার আমাদের দায়িত্ব আমাদের পালন করতে দিন।

তাহলে এ প্রক্রিয়াটা কিভাবে হবে?

এ প্রক্রিয়াটার জন্য মাঠে নামতে হবে। প্রক্রিয়াটার জন্য চকলেট বয় হয়ে ঘরে বসে থাকলে চলবে না। রাজনীতি খারাপ জিনিস, ময়লা জিনিস আমি যাবো না। এটা বললে তো হবে না। রাজনীতি যদি ময়লা হয়, তাহলে তা পরিস্কার করার দায়ভারটা কিন্তু আমাদেরই।

আপনার কাছে কি মনে হয় নতুন প্রজন্মকে দিয়ে সম্ভব?

আমি মনে করি না, আমি বিশ্বাস করি এ প্রজন্ম দিয়ে তা সম্ভব। অসম্ভব কিছু না।

একটা উদাহরণ দিয়ে বলি, বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে হারার পর তাদের গাড়িবহরে কিছু ছেলে জুতা ছুড়ে মারল। সারা বিশ্বে এ নিয়ে নিন্দার ঝড় উঠলো। ওই মুহূর্তে আমাদের নতুন প্রজন্ম কি অসাধারণ কাজ করল!! একটা ফেসবুক গ্রুপ খুলে এক রাতের মধ্যে আলোচনা করে দুই হাজার ছেলেমেয়ে ‘উই আর সরি’ বলে একটা প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে গেলো।

নিজের ভুলের জন্য এই প্রজন্ম ক্ষমা চাইতে শিখেছে। এটা কি পরিবর্তনের ইঙ্গিত নয়? আমার কাছে এই ক্ষমা চাওয়ার গুণটাই অনেক বড় সম্ভাবনা। সম্ভব তো। এই নতুন প্রজন্ম দিয়েই তা সম্ভব।

নতুন প্রজন্মের রাজনীতিতে গুণগত কি ধরনের পরিবর্তন আসা উচিত?

নতুন প্রজন্মের উচিত মাইনাস টু নয়, মাইনাস ফোর নিয়ে ভাবা। প্রতিবার দু নেত্রীকে মাইনাসের কথা আসে। এর কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না। আমি মনে করি, মাইনাস টু ফর্মূলা বাদ দিয়ে মাইনাস ফোর পদ্ধতিতে আসা।

মাইনাস মানেই বিভক্তি। রাজনীতিতে বিভক্তি, প্রতিহিংসা, সংঘাত এবং আবেগকে মাইনাস করতে হবে। আমরা প্রতিহিংসার, সংঘাতের এবং আবেগের রাজনীতি চাই না। ৪০ বছর ধরে আবেগের রাজনীতি চলছে। বাংলাদেশি নাকি বাঙালী। এ বিতর্ক শেষ হয় না।

আপনি বিতর্ক শেষ করতে পারবেন? তাই প্রয়োজন কর্মসূচির রাজনীতি। কিভাবে দারিদ্র বিমোচন হবে, দেশকে ঐক্যবদ্ধ করা যাবে, নাগরিক সমাজকে দেশ গঠনে সম্পৃক্ত করা যাবে এবং দায়িত্ববোধের রাজনৈতিক আবহ তৈরি করা যাবে।

এ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করলেই নতুন প্রজন্ম রাজনীতিতে গুণগত একটা পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

কোনো তরুণ যদি রাজনীতিতে আসতে চায়, তখন সবচেয়ে জরুরী কোনটি?

রাজনীতিতে প্রয়োজন সততা এবং মেধা। শুধু মেধা আছে, কিন্তু সততা নেই। তখন হবে কি জানেন, দুর্নীতিবাজ জাহাজের তেল চুরি করবে। কিন্তু যার মেধা আছে, কিন্তু সততা নেই সে তেল চুরি করবে না; সে গোটা জাহাজটাই গায়েব করে দেবে।

তাই সততা এবং মেধা শুধু এ দুটি গুণ দিয়ে আপনি কিন্তু দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন। তাছাড়া দেশপ্রেম এবং সাহসও রাজনীতিতে জরুরী। সবচেয়ে জরুরী মানসিকতার পরিবর্তন।

তরুণ প্রজন্মকে কি বাংলানিউজের মাধ্যমে কিছু বলতে চান?

অবশ্যই। তরুণ প্রজন্মের প্রতি আমার অনেক কিছু বলার আছে। প্রথমে আমরা দেশকে ভালোবাসতে শিখি। কিন্তু কোথায় সে ভালোবাসা? আমার দেশকে লুটপাট করে চলে যাবে। আমি ঘরে বসে দেখবো এবং ডাইনিং টেবিলে বসে বলব, আমি দেশকে ভালোবাসি।

এখানে ভালোবাসা কোথায়? ভালোবাসার বর্হিপ্রকাশ তো দেখতে পাচ্ছি না। আমার দেশের সম্পদ লুট করছে এটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে তো শরীরের রক্ত গরম হয়ে যাওয়ার কথা। তাই দেশকে যে তোমরা ভালোবাসো সেটা দেখাতে হবে। দেশের জন্য কিছু করে ভালোবাসা প্রকাশ করতে হবে।

দ্বিতীয়ত হচ্ছে, দয়া করে রাজনীতিকে ঘৃণা করো না। এ রাজনীতির কারণেই আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি। রাজনীতির খারাপ সময় যাচ্ছে। তোমরাই এ খারাপ সময়টাতে দেশের পাশে থেকে খারাপ জায়গাগুলো থেকে দেশকে বের করে আনতে হবে। রাজনীতি তো খারাপ না। গুটি কয়েক মানুষ রাজনীতির আবহকে দূষিত করে রেখেছে। তারা সংখ্যায় অনেক কম।

তৃতীয়ত হচ্ছে, দেশ গঠনের প্রক্রিয়ায় নিজেকে সম্পৃক্ত করো। সর্বশেষ হচ্ছে, তুমি একা নও। আসো। এসে দেখো তোমার সঙ্গে সবাই আছে।

সর্বশেষ প্রশ্ন, ২০২১ সালে বাংলাদেশ ৫০ বছর পূর্ণ করবে। ২০২১ সালে ৫০ বছরের বাংলাদেশকে আপনি কেমন দেখতে চান?

২০২১ সালে কেমন দেখতে চাই, অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশ নিয়ে আমার প্রত্যাশা। শুরুতেই বলে নেই, আমি এমন কোনো প্রত্যাশা করতে চাই না যে প্রত্যাশা পূরণ করা সম্ভব না।

২০২১ সালে বাংলাদেশের বয়স হবে পঞ্চাশ। সরকার বলছে, আজকে থেকে ঠিক ১০ বছর পর আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ দেখতে চাই। ভালো কথা। যদিও ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণাটা আমার কাছে খুব একটা পরিস্কার না।

এখনও দেশের শতকরা প্রায় ৪৫ ভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধাবঞ্চিত। এখনও দেশের ৫০ ভাগ মানুষ বিশুদ্ধ পানি পায় না। এখনও দেশের ৬০ ভাগ মানুষের স্যানিটেশন সুবিধাভুক্ত নয়। এমন একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে আমরা ১০ বছর পর ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলছি। স্বপ্ন ঠিক আছে। কিন্তু বাস্তবতাটা কোথায়? সঠিক সময় কি এসেছে? আমার তো মনে হয় না সে সময় এখনও হয়েছে।

যাইহোক, আমি ২০২১ সালের বাংলাদেশকে দারিদ্রমুক্ত দেখতে চাই। আমরা দারিদ্রসীমার উপরে উঠে আসবো। এটা সম্ভব। এটার জন্য প্রধান শর্ত বিদ্যুৎ। বিদ্যুৎ ছাড়া কিভাবে সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলে আমি ঠিক বুঝি না। শুধু ঢাকা শহরেই বিদ্যুৎ দিতে সরকার হিমশিম খাচ্ছে। এ বাস্তবতায় গ্রামগুলোতে কম্পিউটার চলবে কিভাবে?

২০২১ সালের বাংলাদেশকে যদি ডিজিটাল করে দারিদ্রমুক্ত করা যায়, তাহলে সেভাবেই এগিয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু দারিদ্রমুক্ত করতে হলে অ্যানালগ করে এগুতে হয়, তাহলে অ্যানালগ করেই এগিয়ে যাওয়া উচিত।

আপনি শত ব্যস্ততার মধ্যেও বাংলানিউজকে সময় দিয়েছেন এজন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ।

আপনাকেও ধন্যবাদ।

 

বাংলাদেশ সময়: ১৯৫০ ঘন্টা, জুন ১৯, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।