ঢাকা, শনিবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৭ মে ২০২৫, ১৯ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

সুন্দরবনকে আবারো জানি

জেসমিন নাহার লাকি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯:১৩, জুন ২৩, ২০১১
সুন্দরবনকে আবারো জানি

বিশ্বের প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য প্রতিযোগিতায় এই মুহূর্তে সুন্দরবন আছে সবচে এগিয়ে। আমরা আরেকটু সক্রিয় হলেই সুন্দরবন জায়গা করে নিতে পারে পৃথিবীর সাতটি প্রাকৃতিক আশ্চর্যের মধ্যে।

তার আগে আবারও একটু জেনে নিই আমাদের সুন্দরবনকে।

সুন্দরবন নামটি শুনলেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে এক ঘন সবুজ বন আর হলুদ ডোরাকাটা রয়েল বেঙ্গল টাইগারের কথা।
প্রায় ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এ বনের ৬ হাজার বর্গ কিমি রয়েছে বাংলাদেশের ভূখ-ে এবং ৪ হাজার বর্গ কিমি আছে ভারত ভূখ-ে। বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা, নড়াইল জেলায় এই বন বিস্তৃত।

পৃথিবীর এই সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলটির প্রথমে আয়তন ছিল ১৬ হাজার ৭০০ বর্গ কিমি, যা প্রায় ২০০ বছর আগের কথা।
গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং বঙ্গোপসাগরের মিলিত স্থানে অবস্থিত বলে নিয়মিত জোয়ার ভাটার পানি বয়ে যায় এ বনের বিভিন্ন জায়গায়। তাই এর নাম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় ০.৯ মিলিমিটার থেকে ২.১১ মিলিমিটার। বাৎসরিক বৃষ্টিপাত ১৬০০ থেকে ২০০০ মিলিমিটার।

সুন্দরবনের নামকরণ নিয়ে আছে বেশ কিছু মতবাদ। বেশির ভাগ মানুষের মতে, সুন্দরবনের প্রধান গাছ সুন্দরীর নাম অনুসারেই এর নাম সুন্দরবন হয়েছে। আবার অনেকের মতে, সমুদ্রের পাড়ে বনাঞ্চল, তাই এর নাম সুন্দরবন। আরেকটি মতবাদ অনুযায়ী, ‘চান্দ্রাবান্ধি’ নামের বহু আগের এক আদিবাসী গোত্রের নামানুসারে এর নাম সুন্দরবন।

জীববৈচিত্র্য  

সুন্দরবন এক বিশাল জীববৈচিত্র্যের আধার। এখানে রয়েছে বিচিত্র উদ্ভিদরাজির সাথে বিপুল প্রাণবৈচিত্র্য। এক জরিপ অনুযায়ী, সুন্দরবনে প্রায় ১২০ প্রজাতির মাছ, ২৭০ প্রজাতির পাখি, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ৮ প্রজাতির উভচর প্রাণী রয়েছে। এর মধ্যে হুমকির মুখে আছে প্রায় ২ প্রজাতির উভচর, ১৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৫ প্রজাতির পাখি এবং ৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী।

সুন্দরবনের প্রধান প্রাণির মধ্যে বাঘ, হরিণ, বানর, মহিষ, গন্ডার, গিরগিটি, অজগর, কচ্ছপ, শুশুক, চিংড়ি, মোহনার কুমির, কাঁকড়া উল্লেখযোগ্য।

বিপদগ্রস্ত প্রাণির মধ্যে আছে বাঘ, মোহনার কুমির, কচ্ছপ, শুশুক, রাজ কাঁকড়া। গত এক শতাব্দীতে সুন্দরবন থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে ঐড়ম ফববৎ, ধিঃবৎ নঁভভধষড়, ঝধিসঢ় ফববৎ, গঁমমবৎ পৎড়পড়ফরষব এবং একশৃঙ্গ গন্ডারের মতো প্রাণি।
৪০০ নদী-নালা ও খাল এই বনকে বহু ছোট-বড় খ-ে বিভক্ত করে রেখেছে। এই নদী-নালা ও খালে রয়েছে বহু প্রজাতির ফাইটোপ্ল্যাংকটন, জুপ্ল্যাংকটন আর বনে আছে বহু প্রজাতির বৃক্ষ, গুল্ম, লতা, বীরুৎ, শৈবাল, ছত্রাক, পরাশ্রয়ী অর্কিড। প্রধান গাছগুলোর মধ্যে সুন্দরী, গড়ান, গেওয়া, কেওড়া, পশুর, টাইগার ফার্ন, গোলপাতা, হাড়গোজা, হেতাল উল্লেখযোগ্য।
প্রায় ৩০ লাখ লোক এই বন থেকে জীবিকা নির্বাহ করে।
রয়েল বেঙ্গল টাইগার

সুন্দরবনের সাথে যে নামটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তার নাম ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’। বনের রাজা বাঘ নিয়ে কত কল্পকাহিনী আমরা শুনেছি। কিন্তু সেই বনের রাজা বাঘ এখনও কি তার রাজ্য ধরে রাখতে পেরেছে? নাকি মানুষ নামের এক প্রতিপক্ষ তার রাজ্য কেড়ে নিতে সদা সচেষ্ট।

হলুদের মাঝে কালো ডোরাকাটা রঙের বিশাল দেহের এই প্রাণিটি সুন্দরবনের গহিন অরণ্যে বাস করে। পেটের দিক কিছুটা সাদা এবং লেজে কালো রিংয়ের মতো দাগ দেখা যায়। বাংলাদেশ ছাড়া ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার এবং দক্ষিণ তিব্বতেও দেখা যায় রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে।

এই প্রজাতির মেয়ে বাঘের ওজন গড়ে ২২০-৩৫০ পাউন্ড এবং উচ্চতা সাধারণত ৮-৮.৫ ফুট। আর ছেলে বাঘের ওজন গড়ে ৪২০-৫৭০ পাউন্ড এবং উচ্চতা সাধারণত ১০ ফুট। বিশাল এই প্রাণিটি একবারে প্রায় ১৮-২০ কেজি মাংস আহার করে। এর খাদ্যতালিকায় আছে সুন্দরবনের বিভিন্ন প্রাণি, যেমন-হরিণ, বানর, জলমহিষ, গন্ডার, শূকর, খরগোশ, বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, শিয়াল, নেকড়ে, কুমির ইত্যাদি।

বাংলাদেশের এই জাতীয় পশুটি কালের পরিক্রমায় তার আবাসস্থল হারাতে বসেছে। মানুষের জীবিকা নির্বাহ এবং শিকারবৃত্তি হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে আমাদের রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে। গত বছরের ১৩ জুন জাতীয় সংসদে বন ও পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী হাছান মাহমুদ জানান, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা ৪৪০টি। সর্বশেষ বাঘশুমারি ২০০৪ অনুসারে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে বাঁচানোর জন্য আমাদের প্রথমেই ভাবতে হবে সুন্দরবনের ইকোসিস্টেম সংরক্ষণের কথা। কারণ আবাসস্থল কমে যাওয়ার কারণেই বাঘের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।

সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা কমে যাওয়ার আরো কিছু কারণ :

প্রথমেই কারণটি হলো, বাঘ তার আবাসস্থল হারাচ্ছে। সুন্দরবন তার আদি আয়তন থেকে ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। এর একটি প্রধান কারণ সুন্দরবনের চারপাশে প্রায় ৭৬টি গ্রামের অধিকাংশ মানুষের জীবিকা নির্বাহ হয় সুন্দরবনের বিভিন্ন উৎস থেকে। যেমনÑ কাঠ কাটা, মধু, মোম আহরণ, মৎস্য শিকার ইত্যাদি।

চড়ধপযরহম বা বাঘ অপহরণ প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। কারণ বাঘের চামড়া এবং দাঁত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের একটা বড় অংশ।

বাঘের হাড় চাইনিজ ওষুধের একটি বড় উপকরণ। পূর্ব এশিয়ার কিছু অঞ্চলেও ওষুধ তৈরিতে বাঘের হাড় ব্যবহৃত হয়। তাই চামড়া এবং হাড়ের জন্য মানুষ বাঘ হত্যা করছে।

সুন্দরবনে বাঘের খাবারের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। হরিণ কিংবা বানরের সংখ্যা কমছে। কারণ কাঠের ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে প্রচুর গাছ কেটে নিচ্ছে, যা এসব প্রাণির আবাসস্থল। সেই সাথে অবাধে হরিণ শিকারের প্রবণতাও বাড়ছে।

সুন্দরবনের ভেতরে যে প্রায় ৪০০টির মতো নদী-নালা আছে, এগুলোর পানির দূষণ বাড়ছে। জলবায়ূ পরিবর্তনের ফলে নদ-নদীগুলোর প্রবাহ হ্রাস পাচ্ছে এবং নদীর ক্ষীণ প্রবাহের কারণে সামুদ্রিক লোনাপানি সহজেই নদীগুলোর অভ্যন্তরে প্রবেশ করে লবণাক্ততার পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে মিঠা পানির জলজ প্রাণিগুলো বিলুপ্তির পথে, যা বাঘের খাদ্যের একটি অংশ।
আরেকটি বড় এবং প্রধান কারণ হলো সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি। বিজ্ঞানীরা এই কারণটিকেই সবচেয়ে ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশের সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি বছর ৭ মিলিমিটার হারে বাড়ছে, যেখানে ভূপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির হার বছরে ৫-৬ মিলিমিটার। পরিবেশ ও ভূ-বিজ্ঞানীদের মতে সমুদ্রের উচ্চতা ১ মিটার বৃদ্ধি পেলে সুন্দরবনের ৭০ ভাগ তলিয়ে যাবে। ফলে ধবংস হবে এ বনের বিপুল প্রাণবৈচিত্র্য আর বাঘ হারাবে তার স্বাভাবিক বিচরণক্ষেত্র।

কাঠ ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে প্রচুর গাছ কেটে নিচ্ছে, যা অনেক পশুপাখির আবাসস্থল নষ্ট করছে। আবার সমুদ্রে এসিডের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেক প্রাণি পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে পারছে না। ফলে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

সুন্দরবনের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় এবং সাইক্লোনের আঘাতে প্রতি বছরই বিপুল পরিমাণ সম্পদ ধবংস হয় এবং বন্যপ্রাণির জীবন নষ্ট হয়।

আমাদের যা করতে হবে

প্রতি বছর বাঘের আক্রমণে গড়ে প্রায় ১০০-২০০ লোকের প্রাণহানি হয়। মাঝে মাঝে কিছু বাঘ বন থেকে লোকালয়ে চলে আসে। তখন মানুষ তাদের মেরে ফেলে। এ অবস্থায় ঞরমবৎ ধিৎহরহম ধধিৎবহবংং ংুংঃবস জোরদার করতে হবে, যাতে বাঘ লোকালয়ে আসার আগেই গ্রামের মানুষদের সতর্কবাণী দেওয়া যায়।

অবৈধভাবে গাছপালা নিধন বন্ধ করতে হবে।

গ্রামের লোকজনকে পুকুরে মাছ চাষে উৎসাহী করা যেতে পারে, যাতে তারা সুন্দরবনের অভ্যন্তরীণ এলাকা থেকে চিংড়ি কিংবা মাছ কম ধরে।

পশুপাখির খামার গড়ায় তাদের উৎসাহ দিতে হবে।

পর্যটন ব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে।

পর্যাপ্ত শিক্ষার মাধ্যমে গণসচেতনতা বাড়াতে হবে, যাতে বাঘ অপহরণ এবং চামড়া, দাঁত কিংবা হাড় দিয়ে ওষুধ বানানো বন্ধ হয়।

হরিণসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী শিকার বন্ধ করতে হবে।

এনজিওগুলো একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। তারা গ্রামের লোকজনকে সুন্দরবন থেকে জীবিকা আহরণের পরিবর্তে বিকল্প পদ্ধতির জন্য সাহায্য করতে পারে।

রয়েল বেঙ্গল টাইগার সংরক্ষণের বড় দায়িত্ব সরকার এবং বন বিভাগের। বন সংরক্ষণে উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মচারী নিয়োগ করতে হবে।

সমুদ্রের পানির উচ্চতা রোধে বিশ্ববাসীর সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘প্রথমেই বাঘের আবাসস্থলের দিকে নজর দিতে হবে। বাঘ যেন তার বসবাসের অনুকূল পরিবেশ পায়। হরিণ নিধন বন্ধ করতে হবে। আইন সংশোধন করতে হবে এবং জোরদার করতে হবে। সুন্দরবন সংরক্ষণ নীতি করতে হবে। সরকার এবং আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে সুন্দরবন এবং রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে হুমকির মুখ থেকে রক্ষা করতে। ’

প্রতিবেশী ভারতে বাঘ নিধনে ৫০ লাখ রুপি জরিমানাসহ ৭ বছর জেল কিন্তু আমাদের দেশে ২ হাজার টাকা জরিমানা সহ ২ বছর জেল। আবার অনেকে জানেই না এই আইন সম্পর্কে।

বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল ‘সুন্দরবন’ আমাদের ঐতিহ্য। এটি একই সঙ্গে আামাদের প্রাকৃতিক সুরক্ষাকারী। আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা পারে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে এবং সেই সাথে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের জীবন বাঁচাতে।

বাংলাদেশ সময় ১৮০০ ঘণ্টা, জুন ২৩, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।