লালমনিরহাট: হিমালয়ের পাদদেশে সীমান্ত ঘেঁষা লালমনিরহাটে জেকে বসেছে শীত। শীতের এ সময়টাতে অন্যান্য পোশাকের সঙ্গে এ অঞ্চলের মানুষের বড় ভরসার নাম কাকিনার তাঁতের চাদর।
নভেম্বরের শুরু থেকে প্রায় মার্চ পর্যন্ত স্থায়ী দেশের অন্যতম শীতপ্রবণ এ জেলায় স্থানীয়ভাবে তৈরি এ চাদরের জনপ্রিয়তা ব্যাপক। ছিন্নমূল থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত, এমনকি উচ্চবিত্তদের মধ্যেও অনেকের অন্যতম ভরসা কাকিনা তাঁতের চাদর।
তবে শুধু লালমনিরহাটেই নয়, কাকিনার তাঁতের চাদরের কদর রয়েছে দেশজুড়েই। শীতের সময়টাতে কাকিনা থেকে রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীদের চাদর নেওয়ার ধুম পড়ে যায়।
লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনা ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের তাঁতিপাড়ায় তৈরি হয় এ চাদর। বছরের অন্যান্য সময়ে তেমন ব্যস্ততা না থাকলেও শীতের প্রায় পুরোটা সময়জুড়ে চাদর তৈরিতে অবিরাম ব্যস্ততায় সময় কাটে এসব এলাকার তাঁতিদের।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেলো, কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনা উত্তর বাংলা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের পাশের গ্রাম তাঁতিপাড়া। গ্রামে প্রবেশের আগে কানে বাজে তাঁত মেশিনের খট-খট শব্দ। গ্রামের যতো ভেতরে যাওয়া যায়, প্রায় সব বাড়িতেই ছেলেবুড়া সবাই ব্যস্ত তাঁত নিয়ে। এখন চলছে তাদের চাদর তৈরির ভরা মৌসুম।
গ্রামের এক বাড়িতে প্রবেশ করে দেখা গেল, পরিবারের সবাইকে নিয়ে তাঁতে ব্যস্ত প্রবীণ তাঁতি আরফান আলী (৮০)।
কথা হয় গ্রামের প্রবীণ এ তাঁতির সঙ্গে। তিনি জানান, দেশ স্বাধীনের আগেই কয়েকজন মিলে তারা টাঙ্গাইল থেকে চলে আসেন এখানে, কাকিনায়। এরপর তিলে-তিলে গড়ে তুলেছেন এ তাঁতপল্লী।
তিনি জানান, কয়েক বছর আগেও গ্রামে ৩৫০ থেকে ৪০০ পরিবার তাঁতপেশায় জড়িত ছিল। কিন্তু নানান কারণে বর্তমানে অনেকেই এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। অনেকে অন্যান্য পেশায় জড়িয়ে পড়েছেন। ফলে আগের মতো তাঁতিদের আর কদর নেই। কিন্তু বাপ-দাদার পেশাক আঁকড়ে ধরেই পড়ে আছেন তিনি, আছেন তার মতো গ্রামের অনেকেই।
আরফান আলী জানান, সুতার দাম বেশি। এছাড়া সবসময় তাদের চাদরের চাহিদা থাকে না। ফলে অর্থাভাবে এ পেশা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন অনেকে।
তিনি জানান, দাঁদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে সুতা কিনে কোনোরকমে বাকিরা টিকিয়ে রেখেছেন এ এলাকার তাঁত শিল্পকে। তবে সুদের হার ব্যাপক চড়া। প্রতি হাজারে প্রতিমাসে ১০০ থেকে ১২০ টাকা সুদ দিতে হয়।
তিনি দাবি করেন, সরকারিভাবে বা কোনো প্রতিষ্ঠান সুতা আর মজুরি দিলে বার মাসই তারা চাদর, লুঙ্গি, শাড়িসহ বিভিন্ন পোশাক তৈরি বা সরবরাহ করতে পারতেন। তাই তাঁত শিল্পকে বাঁচাতে সরকারের সার্বিক সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।
গ্রামের আরেক তাঁতি আমজাদ হোসেন। বাল্যকাল থেকেই পরিবারের মাধ্যমে এ পেশায় জড়িত। এর ফাঁকেই এইচএসসি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। কিন্তু অর্থাভাবে উচ্চশিক্ষা অর্জন করা সম্ভব হয়নি তার। ফলে অনেকটা বাধ্য হয়েই এ পেশাকে আঁকড়ে ধরে আছেন।
তিনি জানান, এখন শীতের চাহিদা মেটাতে শুধু চাদর তৈরি করছেন তারা। এভাবে ৫ মাস ভালো চললেও বছরের বাকি সময়টা বন্ধ থাকে তাঁত। এ সময়টা দুর্বিষহভাবে কাটে তাদের।
আমজাদ হোসেন জানান, দাদন ব্যবসায়ীদের যাতাকলে পিষ্ট হতে হচ্ছে তাদের। সরকারি কোনো ঋণ না পেয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ক্রমশ নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন এ পেশার অনেকে।
কাকিনার রুদ্বেশ্বর গ্রামের তাঁত শ্রমিক ছকিনা বেগম জানান, দৈনিক ভোর ৫টায় কাজ শুরু করেন তার পরিবারের ৪ জন। রাত ১০টা পর্যন্ত কাজ করে মোট ৬টি চাদর তৈরি করতে পারেন তারা। প্রতি চাদরে তাদের খরচ পড়ে ১০০ টাকার মতো, বিক্রি হয় ১৩০ থেকে ১৫০ টাকায়।
কলেজপাড়ার তাঁত শ্রমিক তমিজ উদ্দিন জানান, তারা প্রতিমণ সুতা ৬/৭ হাজার টাকা দরে কেনেন বগুড়া শহর থেকে। তিনি মহাজনের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে সুতা কিনেছেন। বিনিময়ে মহাজনের কাছে বাজারমূল্যের চেয়ে প্রতিটি চাদর ৫/৮ টাকা কমিশন দিয়ে বিক্রি করতে হবে তাকে।
তাঁতিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কাকিনার তাঁতপল্লীর তৈরি চাদর জেলার চাহিদা মিটিয়ে চলে যায় টাঙ্গাইল, ঢাকার বাবুরহাট, বরিশাল ও ঝিনাইদহসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।
এসব তাঁতিদের দাবি, তাদের এ পেশা টিকিয়ে রাখতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হোক। সরকারি সহায়তা পেলে সারাবছর তারা চাদর, লুঙ্গি, শাড়িসহ বিভিন্ন পোশাক তৈরি করে বাজারজাত করতে পারতেন। এতে তাদের পরিবারের ভরণ-পোষণের চিন্তা থাকতো না। দূর হতো বাপ-দাদার পেশা টিকিয়ে রাখা নিয়ে শঙ্কা।
বাংলাদেশ সময়: ০৩১০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৯, ২০১৬
এসআর/জেডএম