ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

ওই যায় ‘মইওয়ালা’

এম. আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০২৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১৬
ওই যায় ‘মইওয়ালা’ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

জোরবাড়িয়া, ফুলবাড়িয়া, ময়মনসিংহ থেকে ফিরে: হালের বলদের রশি ধরে এগোচ্ছেন আকবর হোসেন খান। ডাক নাম সংগ্রাম।

বয়স পঁয়তাল্লিশের কোটায়। মাথায় গামছা বাঁধা। কাঁদায় একাকার মুখ। কাঁধে বাঁশের তৈরি মই আর জোয়াল।

চলতি বোরো মৌসুমে কলের ট্রাক্টর দিয়ে ক্ষেতে-খামারে হালচাষের পর জমির মাটি সমান করতে মই দেওয়ার কাজ করেন এই ‘মইওয়ালা’। কৃষি প্রধান ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার জোরবাড়িয়া গ্রামে তার বাড়ি।

কলের পাওয়ার টিলার বা ট্রাক্টর দিয়ে দ্রুত জমি চাষ করা গেলেও সমান হয় না। আর তখনই ডাক পড়ে মইওয়ালার। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় গরুটানা লাঙলে হালচাষ বিলুপ্ত হলেও ক্ষেতে-খামারে গরুটানা মই দিয়ে বেড়ান তিনি।

বৃহস্পতিবার (৪ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে আলাপ হয় আকবর হোসেন খানের সঙ্গে। আলাপ ফাঁকে একজন ডাকলেন, ‘ওই মইওয়ালা হোন। আমগরে মই দিয়া দিওন লাগবো। ’

ওই কৃষকের সঙ্গে চুক্তির সময়ে মইওয়ালার ঠোঁটের কোণে হাসিই বলে দিচ্ছিল এই গ্রামে মই দেওয়ার কাজে তার জনপ্রিয়তা।

বাবার কাছেই জমিতে মই দেওয়ার কাজ শিখেছেন আকবর। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় জন্ম নেওয়ায় বাবা তার নাম রাখেন সংগ্রাম। নিজের জীবন সংগ্রামও শুরু হয় সেই শৈশবেই।

বিয়ের পর অভাব-অনটনে স্ত্রী-সন্তানদের মুখে খাবার জোটানোই ছিলো কঠিন। কিন্তু দমে যাবার মানুষ নন তিনি।

বাবার ঐতিহ্য ধরে রাখার পাশাপাশি সংসারের হাল ধরতেই এখনো জমিতে গরু দিয়ে মই দেওয়ার সনাতনী পদ্ধতিকে ধরে রেখেছেন। যন্ত্রের দাপটে অনেকেই এ পেশা বদল করলেও সংগ্রাম নিজেকে ঠিকই টিকিয়ে রেখেছেন।

স্থানীয় কৃষকরা জানান, এক সময় লাঙল-জোয়াল ও হালের বলদ ছাড়া হালচাষ চিন্তাই করা যেতো না। হালের একজোড়া বলদ দিয়ে একরের পর একর জমি চাষাবাদ করতেন তারা। শুধু হালচাষের জন্যই ওই সময় গরু লালন-পালন করতেন তারা।

কিন্তু এখন সময় বদলেছে। গ্রামে গ্রামে হালের বলদের সঙ্কট। প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় কৃষিক্ষেত্রেও বেড়েছে যান্ত্রিক চাষাবাদ। ফলে হালচাষে গরু, লাঙল আর জোয়ালের কদরও কমেছে।

জমিতে মই দিতে প্রতি কাঠায় (সাড়ে ৬ শতাংশে ১ কাঠা) ৫০ থেকে ৬০ টাকা মজুরি পান আকবর ওরফে সংগ্রাম। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বিরামহীনভাবে একরের পর একর জমি চষে বেড়ান তিনি। প্রতি কাঠা জমি মই দিতে তার সময় লাগে মাত্র ১০ মিনিট।

বাংলানিউজকে সংগ্রাম বলেন, অহন মেশিনেই সবাই চাষবাস করে। কম সময়ে বেশি জমিতে চাষ দেওয়ার সুবিধার কারণেই সবাই মেশিনেই ঝুঁকছে। কিন্তু জমিত মই দিবার লেইগ্যা অহনও সবাই আমারেই ডাকে। গোটা গ্রামে কেবল আমারই এক জোড়া হালের বলদ আছে।

প্রতিদিন সকালে আটার রুটি খেয়ে বাড়ি থেকে বের হন সংগ্রাম। ক্ষেতের আইলে বসেই দুপুরের আহার সারেন। বোরো বা আমন মৌসুমের কোনো সময়েই তাকে বেকার বসে থাকতে হয় না। প্রতিদিনই কাটে লাঙল, জোয়াল ও মই দিয়ে অন্যের জমি চষে বেড়িয়ে।

চলতি বোরো মৌসুমে প্রতিদিন ১৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা উপার্জন করেন সংগ্রাম। বললেন, বাড়িতে এসে কিংবা মোবাইল ফোনে জমিতে মই দেওয়ার চুক্তি করেন সবাই। এ মৌসুমে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা পাইছি।  

মেশিনে মই দেওয়া পরিবেশসম্মত নয় বলে মনে করেন এ মইওয়ালা। তার কথায়, গরু আর লাঙল দিয়ে মই দেওয়ার ফলে জমির উপরের মাটি নিচে আর নিচের মাটি উপরে মিশে যায়। এতে মাটি ঠিকভাবে সমান ও নরম হয়। তখন ধানের চারা রোপন সহজ হয়। ফলনও ভালো হয়।

সংগ্রাম আরও জানান, বোরো মৌসুম শেষ হলেই হালের বলদ বিক্রি করে দেবেন। আবার মৌসুম শুরু হবার আগে একজোড়া বলদ কিনবেন। গত মৌসুমেও ৮০ হাজার টাকায় কেনা গরু দেড় লাখ টাকায় বিক্রি করেছিলেন। বিলুপ্তপ্রায় এ পদ্ধতি টিকিয়ে রেখেই তিনি বদলেছেন নিজের ভাগ্য।

অন্যের জমিতে মই দিয়ে নিজের সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছেন তিনি। এই পেশা থেকে উপার্জিত টাকা দিয়েই নিজের মেয়েকে এসএসসি পাস করিয়ে বিয়ে দিয়েছেন। আরেক সন্তান এখন স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। সেও পড়াশুনা শিখে চাকরি করবে, এমন স্বপ্ন দেখেন তিনি।

** ইজিবাইকে ঘুরছে ভাগ্যের চাকা
** ফুল চাষে ভাগ্যবদল

বাংলাদেশ সময়: ০০১০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১৬
আরএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।