বর্তমান বিশ্বে দ্রুত বিকাশমান শিল্প হিসেবে পর্যটন সুপ্রতিষ্ঠিত। একটা সময় ছিল যখন পর্যটনের কর্মকা- শুধু সমুদ্র সৈকতে অল্পবিস্তর বিনোদন সুবিধার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।
ইকোট্যুরিজম হলো একান্ত নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশে ভ্রমণের মাধ্যমে জ্ঞানার্জন বা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের উদ্দেশ্যে বন ও বন্যপ্রাণীর সৌন্দর্য অবলোকন। এটা একটি সামগ্রিক অভিজ্ঞতা যার মাধ্যমে দর্শনার্থীরা প্রকৃতির আকর্ষণগুলোকে উপলব্ধি করতে পারেন। ইকোট্যুরিজম বলতে পরিবেশগত ও সংস্কৃতিগতভাবে টেকসই পর্যটন উন্নয়নকে বোঝায়, যা সমাজের বৃহত্তর অংশ ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের আর্থিক ও সামাজিকভাবে লাভবান হবার বিষয়টি নিশ্চিত করে। ব্যাপকভাবে, ইকোট্যুরিজম বলতে বোঝায় প্রকৃতির সংরক্ষণকে ত্বরান্বিত করার মাধ্যমে এর সৌন্দর্যকে (সেই সাথে অতীত ও বর্তমানের যে কোনো সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য বা দর্শনকে) অনুধাবন/হৃদয়ঙ্গম করার উদ্দেশ্যে অপেক্ষাকৃত শান্ত প্রাকৃতিক পরিবেশে ভ্রমণ বা পরিদর্শন। প্রকৃতির সংরক্ষণ ও উন্নয়নের উদ্দেশ্যে স্থানীয় জনগণ, প্রকৃতি সংরক্ষণকর্মী ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের মাঝে অংশীদারিত্বই হলো ইকোট্যুরিজম। ইকোট্যুরিস্টরা অজানা ও অনাবিষ্কৃত ¯হান পরিদর্শন বা ভ্রমণের মাধ্যমে এর সম্ভাব্য উন্নয়নের জন্য ইতিবাচক অবদান রাখেন। অবশ্য, তাদের ভ্রমণের জন্য সুবিধাজনক অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে অথবা তাদের ভ্রমণের ফলে যেন পরিদর্শনকৃত ¯হানের কোনো ক্ষতি না হয়, সে বিষয়টি তারা নিশ্চিত করতে সচেষ্ট হন।
ইকোট্যুরিজমের উৎপত্তি ঘটেছে পরিবেশের যথার্থ রক্ষণাবেক্ষণের ভাবনা থেকে। গোটা বিশ্বের পরিবেশে যখন গ্রিন হাউসের ধ্বংসাত্মক প্রভাব দেখা গেল, সে মুহূর্তে একদল সচেতন মানুষ পৃথিবীকে এবং এর পরিবেশকে রক্ষার উদ্দেশ্যে আন্দোলন শুরু করল। তাদের আন্দোলনের এক পর্যায়ে দেখা গেল গণপর্যটনের বিকাশ বিশ্বের পরিবেশগত ভারসাম্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। তখন থেকে পরিবেশের ভারসাম্যে বিঘœ না ঘটিয়ে পর্যটনের উন্নয়নের জন্য ইকোট্যুরিজম একটি নতুন ধারণা হিসেবে জন্মলাভ করে। এর মাধ্যমে প্রাকৃতিক স¤পদ ও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি ও ধ্বংসসাধন না করে পর্যটন উন্নয়ন করা সম্ভব। এক্ষেত্রে প্রাকৃতিক স¤পদের বৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও এর সহনশীল ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন সমনি¦ত উদ্যোগ। এ ব্যাপারগুলো মানবজীবনের গুণগত মান উন্নয়নেও সহায়ক।
প্রতিবেশবিদরা স¤পদের ব্যব¯হাপনার ক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়নের কথা বলেন। আর টেকসই উন্নয়নের সবচেয়ে জনপ্রিয় সংজ্ঞা হলো : ‘আগামী প্রজন্মের জন্য স¤পদের হ্রাস না ঘটিয়ে, বর্তমানের চাহিদা পূরণ। ’
২০০২ সালকে জাতিসংঘ ইন্টারন্যাশনাল ইকোট্যুরিজম ইয়ার হিসেবে ঘোষণা করেছে। এই ঘোষণার সাথে সাথে জাতিসংঘ বিশ্ব পর্যটন সং¯হা এবং অন্যান্য সং¯হাকেও ‘ইন্টারন্যাশনাল ইকোট্যুরিজম ইয়ার’ উপলক্ষে এর লক্ষ্যসমূহ অর্জনের জন্য কার্যক্রম গ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছে। এসব অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য হলো ¯হানীয় জনসাধারণ এবং অন্য দেশ থেকে আগত আন্তর্জাতিক পর্যটকদের মাঝে পর্যটন স¤পর্কে বিশেষত, ইকোট্যুরিজম স¤পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা।
ইকোট্যুরিজম উন্নয়ন ও বিকাশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। বিশ্বের একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন (প্রায় ৬,০১৭ বর্গমাইল) বাংলাদেশের গর্ব ও ইকোট্যুরিজমের সোনার খনি। এই বনভূমি ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্য এলাকা বলে ঘোষিত হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য ইকোট্যুরিজম আকর্ষণের মধ্যে রয়েছে বৃহত্তর সিলেটে চা বাগান, চিরসবুজ পার্বত্য এলাকা, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, কক্সবাজার ও কুয়াকাটার রুপালি বালুকাময় সৈকত, নদ ও নদী, হাওর অঞ্চল, বন ও বন্যপ্রাণী, বর্ণাঢ্য আদিবাসীদের জীবন ও সহজ সরল গ্রাম্য জীবন-ধারা। বিশ্বের পর্যটন বাজারে এই অজানা ও অনাবি®কৃত পর্যটন পণ্যের বিস¥য়কর চাহিদা রয়েছে। টেকসই পর্যটন উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন এই পর্যটন পণ্যের ধারণক্ষমতা নির্ধারণ এবং তাদের সযতœ পরিচর্যা, যথার্থ পরিকল্পনা ও ব্যব¯হাপনা, অনন্য পর্যটন স¤পদের সংরক্ষণ, পর্যটন পণ্যের বিপণন এবং আগ্রহী পর্যটকের কাছে তা সফলভাবে উপ¯হাপনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা।
বাংলাদেশে ইকোট্যুরিজমের সম্ভাবনা উন্মোচনের লক্ষ্যে সরকারি, আধাসরকারি, বেসরকারি সং¯হাগুলোর সমনি¦ত ও যৌথ পরিকল্পনা গ্রহণ করা আবশ্যক। দীর্ঘদিন যাবৎ ইকোট্যুরিজমসহ গণপর্যটনকে এ দেশে বিকাশের জন্য প্রয়াস নেওয়া হয়েছে। সরকার ইতোমধ্যে পর্যটনকে একটি শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং ২০১০ সালে একটি নতুন জাতীয় পর্যটন নীতিমালা ঘোষণার মাধ্যমে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যটনকে উৎসাহিত করার পদক্ষেপ নিয়েছে।
বাংলাদেশের জন্য ইকোট্যুরিজম তুলনামূলকভাবে নতুন ধারণা হওয়া সত্ত্বেও ঘোষিত জাতীয় পর্যটন নীতিমালায় যথাযথ গুরুত্বসহ এ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রকৃতি ও সং¯কৃতির আসল রূপ কাছ থেকে আবিষ্কার করার নেশা পর্যটকদের মধ্যে দিনে দিনে বাড়ছে। সরকারও আন্তর্জাতিক পর্যটন বাজারের সাম্প্রতিক ধারা অনুধাবন করে প্রকৃতি ও সং¯কৃতির সব উপাদানের মৌলিকত্ব রক্ষার মাধ্যমে পর্যটনশিল্প বিকাশে অত্যন্ত আগ্রহী। দেশের প্রাকৃতিক ও সাং¯কৃতিক আকর্ষণ সংরক্ষণ করা সবার জাতীয় দায়িত্ব। পুরো জাতিকেই এই পবিত্র দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
জাতীয় উদ্যান এবং সংরক্ষিত বনাঞ্চলে স¤পদের পরিকল্পিত সংরক্ষণ, বনায়ন এবং তা পরিবর্ধনের মাধ্যমে বন বিভাগ ইকোট্যুরিজম প্রসারে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। কারণ সরকারি নীতিমালা এবং আইনের অধীনে বন ও বন্যপ্রাণীসহ সব স¤পদের টেকসই উন্নয়ন সুনিশ্চিত করার জন্য বন বিভাগকে কর্তৃত্ব দেওয়া আছে। মূলত বনভূমি এলাকাতেই অধিকাংশ ইকোট্যুরিজম উপযোগী প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। তাই দেশে বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ এবং বিস্তারের উদ্দেশ্যে সরকার ৮টি অভয়ারণ্য, ৫টি জাতীয় উদ্যান এবং ৩টি রিজার্ভ এলাকা ঘোষণা করেছে।
বন বিভাগ এবং এর অধীনস্থ অন্যান্য দপ্তরে ইকোট্যুরিজমের উন্নয়ন ও বিকাশের জন্য সীমিত আকারে অবকাঠামোগত সুবিধাদি রয়েছে। ইকোট্যুরিজম বিকাশের জন্য তারা ইকোট্যুরিস্ট ও ট্যুর অপারেটরদের সহায়তা দিয়ে থাকে। সরকার ইতোমধ্যেই প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প নিয়েছে। ¯হানীয় এবং আন্তর্জাতিক অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন এই প্রকল্পসমূহের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে ইকোট্যুরিজমকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক দাতা সং¯হার কারিগরি ও আর্থিক সহায়তায়। এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন দেশে অনুপম প্রকৃতি ও মূল্যবান বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও বিস্তারের কর্মসূচি জোরদার করবে। ইকোট্যুরিজমের চেতনাতেই এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর মধ্যে সেন্টমার্টিন দ্বীপে ইকোট্যুরিজমের উন্নয়ন ও মেরিন পার্ক ¯হাপন; সীতাকুণ্ডে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, ইকোপার্ক ও বোটানিক্যাল গার্ডেন প্রতিষ্ঠা এবং সুন্দরবনে জীববৈচিত্র সংরক্ষণ ইত্যাদি ইকোট্যুরিজমভিত্তিক প্রকল্প বর্তমানে দ্রুত বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।
আমাদের জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মীয় ও সামাজিক চেতনার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে বলা যায়, পরিবেশ সংরক্ষণ ও বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে এই সম্ভাবনাময় দিকটিকে তুলে ধরে এক্ষেত্রে যথেষ্ট সফলতা অর্জনের সুযোগ রয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রশংসা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক কাজ। এছাড়া আদিকাল থেকেই ধর্মীয় শিক্ষাব্যব¯হায় পরিবেশ-নীতির বিষয়টি এর একটি অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। অন্যদিকে পরিবেশবান্ধব পর্যটন তথা টেকসই পর্যটন উন্নয়নসহ সমসাময়িক সব উন্নয়নের কৌশল হিসেবেও এটি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্য জীবন্ত সং¯কৃতি এবং স্রষ্টার অনবদ্য সৃষ্টি প্রকৃতিকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ ও বিকাশে সহায়তা দানের ব্যাপারে জনগণের এই চেতনাবোধকে কাজে লাগিয়ে ইকোট্যুরিজমকে সামাজিক আন্দোলনে রূপান্তর করা দরকার।
বাংলাদেশ সময় ১৫২৫, জুন ২৯, ২০১১