ঢাকা, শনিবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৭ মে ২০২৫, ১৯ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

মিশ্র ফলবাগানের জাদুকর

আব্দুর রফিক মজিদ, শেরপুর থেকে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২:১৪, জুলাই ২, ২০১১
মিশ্র ফলবাগানের জাদুকর

শুধু ধানচাষের উপর নির্ভরশীল না থেকে ফলের আবাদ করে সংসারের অভাব দূর করে সফল হয়েছেন ফলবাগানের জাদুকর হিসেবে পরিচিত মুক্তিযোদ্ধা ও কৃষক  সামছ উদ্দিন মিয়া।  

শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতি উপজেলার ভারুয়া জারুলতলা গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য ও মুক্তিযোদ্ধা সামছ উদ্দিন তার সাড়ে তিন একর জমিতে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ফলের বাগান করে সারা জেলায় ব্যাপক সাড়া ফেলেছেন।



মাত্র ৩০টি আম্রপলির চারা রোপণ করে বর্তমানে ৩৫ প্রজাতির প্রায় সাড়ে ৩০০ আমগাছসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রজাতির আরো শতাধিক গাছের ফলবাগান এবং প্রতি বছর বিভিন্ন ফলগাছের প্রায় এক লাখ  চারা তৈরি করে বিক্রি করেন। এতে তিনি বছরে ৬ থেকে ৮ লাখ টাকা আয় করছেন। তার এই যাদুকরি ফলচাষ ও ফলবাগান দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওই গ্রামসহ আশপাশের আনেক গ্রামে প্রায় শতাধিক ব্যক্তি ফলচাষ বা বাগান তৈরি করে স্বাবলম্বী হয়েছেন।

সামছ উদ্দিন এই মিশ্র ফলচাষ করে গত বছর (২০১০ সালের ২৬ জুলাই) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদকে’র দ্বিতীয় পুরস্কার হিসেবে একটি রৌপ্য মেডেল, ১৫ হাজার টাকা, সনদ ও ক্রেস্ট পেয়েছেন। এছাড়া ২০০৫ সালে ঢাকায় ফলমেলায় শ্রেষ্ঠ ফলচাষির পুরস্কার, ২০০৬ সালে জাতীয় বৃক্ষমেলায় তৃতীয় স্থান এবং ২০০৮ সালে ঢাকায় ফলমেলায় বিশেষ পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। তার বাগানে প্রতি বছর মধুমাসে থোকা থোকা বিভিন্ন প্রজাতির আম, লিচু, কাঁঠাল, জামসহ বিভিন্ন ফলের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে গ্রামজুড়ে। তার বাগান দেখতে প্রতিদিনই ভিড় করেন বহু মানুষ।

মুক্তিযোদ্ধা সামছ উদ্দিন জানান, ১৯৭১ সনে তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন ১১ নম্বর সেক্টরের অধীনে। দেশ স্বাধীন হলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চিটাগাংয়ের বেঙ্গল রেজিমেন্টের সার্জেন পদে চাকরি নেন। ১৯৯৩ সালে চাকরি থেকে অবসর পেয়ে চলে আসেন নিজ গ্রাম ঝিনাইগাতির ভারুয়া জারুলতলায়। এখানে তার পৈতৃক প্রায় সাড়ে ৩ একর জমিতে প্রথমে বিভিন্ন চাষাবাদ এবং হাঁস-মুরগি পালন ও পোল্ট্রি ফার্ম করেন। কিন্তু এতে তেমন সফলতা পাননি। পরে ২০০১ সালে স্থানীয় ব্র্যাকের মাধ্যমে তার বাড়ির পরিত্যক্ত জায়গায় ৩০টি আম্রপলির চারা রোপণ করেন। সেই থেকেই তার সাফল্যের পথে যাত্রা। বছর ঘুরতেই তার ওই আম্রপলি গাছের থোকা থোকা আম দেখে বিমোহিত সামছ উদ্দিন সিদ্ধান্ত নেন ফলের বাগান করার। ধীরে ধীরে তার বাগানে বাড়তে থাকে আম, কাঁঠাল, লিচুসহ বিভিন্ন প্রজাতির ফলগাছ। এক সময় সিদ্ধান্ত নেন বিদেশি ফলগাছ রোপণ করার। বিশেষ করে যেসব ফলগাছ বাংলাদেশে নেই বা উৎপাদন হয় না সেসব ফলগাছ বিভিন্নভাবে বিদেশ থেকে এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে খোঁজ করে চারা  এনে ও কলম তৈরি করে তার বাগানের পরিধি বাড়াতে থাকেন। বিদেশি ফলের মধ্যে আমেরিকান ক্যান্ট ও বেনিসন আম; ভারতের আঙুর, আপেল, কমলা, মাল্টা, নাশপাতি; মালয়েশিয়ার বিখ্যাত রামবুটান, ম্যাঙ্গুস্টিন, লংগেন; ইংল্যান্ডের পিচফল; সৌদি আরবের খেজুরসহ নানা ফলের গাছ রোপণ করেন। ওসব ফলগাছ রোপণ করে ইতিমধ্যে তিনি বেশ সাফল্য অর্জন করেছেন। বিশেষ করে ভারতের কমলা, আপেল, আঙুর আর আমেরিকার ক্যান্ট আম ফলিয়ে গ্রামবাসীকে তাক লাগিয়েছেন।

সামছ উদ্দিনের মিশ্র ফলবাগানে উল্লিখিত বিদেশি ফলগাছ ছাড়াও দেশি-বিদেশি আরো যেসব গাছ রয়েছে সেগুলো হলো ২৫ প্রজাতির আম, ৭ প্রজাতির লিচু, ৫ প্রজাতির পেয়ারা, ৫ প্রজাতির জামরুল, ২ প্রজাতির কমলা ও সবেদা, বারোমাসি আমড়া, বরই, জাম, বেল, বাওকুল, কলা, পেঁপে, কাঠাঁল, আনারসসহ ৭০ প্রাজাতির কয়েকশ গাছ । এছাড়া তিনি প্রতি বছর প্রায় এক লাখ বিভিন্ন ফলের চারা উৎপাদন করে বিক্রি করে থাকেন। গত বছর ৮০ হাজার চারা বিক্রি করলেও এবার ৯০ হাজার চারা বিক্রি করেছেন বলে জানালেন।

এছাড়া তিনি বাড়ির সামনে একটি পুকুরে রুই, কাতলা, পাঙ্গাশসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ এবং বাগানের ফাঁক-ফোঁকরে শিম, বেগুন, লাউ, ঢেঁড়শ, মূলা, পুঁইশাকসহ বিভিন্ন সবজি চাষ করেও বাড়তি আয় করে থাকেন।

সামছ উদ্দিন তার বাগানের সার্বক্ষণিক পরিচর্যার জন্য ২০ জন লোক রেখেছেন।

সামছ উদ্দিন মিয়া জেলার প্রতিটি বৃক্ষ ও কৃষিমেলাতেই তার বাগানের ফল ও ফলের তৈরি বিভিন্ন আচার ও চাটনি নিয়ে স্টল দেন। তিনি তার বাড়িটিও পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলেছেন। তার বাড়িতে সৌরবিদ্যুৎ ও বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট রয়েছে।

সামছ উদ্দিনের তিন ছেলের মধ্যে বড় ছেলে তার সাথে বাগান দেখাশোনা করেন এবং মেজ ছেলে পুলিশ বিভাগে ও ছোট ছেলে নেত্রকোনায় কৃষি বিভাগের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করছেন। সামছ উদ্দিন শেরপুরের এই সীমান্তবর্তী গারো পাহাড় এলাকার কৃষিতে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে ফল চাষে এবং ফল বাগানে উদ্বুদ্ধ করে স্বাবলম্বী করে তুলতে চান।  

বাংলাদেশ সময় ২১১৯ ঘণ্টা, জুলাই ২, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।