সময়টা ১৯৪২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর। বার্মার স্বাধীন আর্মি কমান্ডার অং সান বিয়ে করেছেন রেঙ্গুন জেনারেল হাসপাতালের একজন সিনিয়র নার্সকে।
তাদের সাধারণ সংসারে ১৯৪৫ সালের দিকে জন্ম হয় এক কন্যাসন্তানের। অবশ্য তার আগেই দুজন পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে ফেলেছে। তবে আদরের কন্যাসন্তান পেয়ে বাবা-মা দুজনই অনেক খুশি।
বাবা-মা দুজনেরই খুব ইচ্ছে মেয়ের মাঝে বেঁচে থাকার। তাই মেয়ের নাম দেয়া হলো দুজনের নামের সাথে মিলিয়ে। বাবার থেকে নেওয়া হয় ‘অং সান’, মায়ের থেকে নেওয়া হয় ‘চি’। তবে বাবা চাইলেন তার নিজের মায়েরও নাম যুক্ত করতে। মায়ের নাম থেকে নেওয়া হলো ‘সু’। এভাবেই মেয়ের পুরো নাম হয়ে গেলো অং সান সু চি।
এই নামটি যে ইতিহাস হয়ে যাবে তা কি তখন সেই দম্পতি বুঝতে পেরেছিলেন?
তবে সু চি এখন আর কেবল বার্মার নন, পৃথিবীর ইতিহাসেই নিজের নাম লিখিয়ে নিয়েছেন। বার্মার নাম এখন মিয়ানমার। আর এই মিয়ানমারকে সু চির চোখ দিয়েই দেখে গোটা বিশ্ববাসী।
অক্সফোর্ডে থেকে পড়াশোনা করেছেন সু চি। ১৯৭১ সালে বিয়ে করেছেন মাইকেল অ্যারিসকে। তাদের ভালোবাসার সংসারে জন্ম হয়েছে দুই ছেলেসন্তানের।
তার রাজনীতিতে আসাটা একদমই হুট করে। ১৯৮৮ সাল। সু চি হঠাৎ ফোনে খবর পান যে তার মা স্ট্রোক করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মায়ের অসুস্থতার কথা শুনেই সুচি প্লেনে করে চলে আসেন রেঙুন। তখন মিয়ানমারের রাজনীতি উত্তাল। স্বৈরশাসকেরা তখন বিপুল আন্দোলনের মুখে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা রাস্তায় হাজার হাজার মানুষকে গুলি করে মারছে। সু চির পরিবার মিয়ানমারের ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে। পুরো পরিবারটাই পাবলিক ফিগার। সেই ইতিহাস আরও বৃহৎ।
সেই উত্তাল মুহূর্তে ১৫ আগস্ট সু চি প্রথম পদক্ষেপ নেন। দেশের একজন নাগরিক হিসেবে সরকারকে চিঠি পাঠান। সেখানে তিনি বলেন, একটি সুষ্ঠু-স্বাধীন বহুদলীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের, যেখানে অংশগ্রহণ করবে গণতন্ত্রের পক্ষের সব দল।

সারা বিশ্ব সে দিন থেকেই সুচির কণ্ঠের সাথে তাল মেলাতে শুরু করে। জনগণ মাঠে নেমে পড়ে। এদিকে ১৯৮৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর সুচির মা ‘কিন চি’ মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েন। অনেকটাই ভেঙে পড়েন সু চি। তবে কিন চির শেষকৃত্য-অনুষ্ঠানে হাজার হাজার জনতার উপস্থিতি সু চিকে বিস্মিত করে। সেই দিন সু চি দেশের প্রতি এক অন্যরকম দায়িত্ব অনুভব করেন। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, এ দেশের মানুষের জন্য বাকি জীবন লড়াই করে যাবেন।
নতুন উদ্যমে সু চি প্রচার চালাতে থাকেন। এবং একই বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর National League for Democracy (NLD) নামে দল গঠন করেন। সেই দলের জেনারেল সেক্রেটারি নির্বাচিত হন তিনি। সোচ্চার সুচিকে ১৯৮৯ সালের ২০ জুলাই কোনো ধরনের অভিযোগ ছাড়াই গ্রেফতার করা হয়।
এরপর ১৯৯০ সালে বহুদলীয় নির্বাচন হলো। সু চির দল ৮২% ভোট পেয়ে নির্বাচিত হলো। কিন্তু ক্ষমতা হস্তান্তর হলো না। উল্টো বন্দি করা হলো সুচিকে। আর সেই সাথে বন্দি হয়ে গেলো মিয়ানমারের গণতন্ত্র।
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় জোরালোভাবে লড়াই করার জন্য ১৯৯১ সালে অং সান সু চি পেলেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার। সেই পুরুস্কার গ্রহণেরও অনুমতি মেলেনি সুচির। সুচিকে বলা হলো, যদি তিনি দেশ ছাড়েন তবে মিয়ানমার এবং এর রাজনীতি থেকে সরে যেতে হবে। তাহলে তিনি মুক্তি পাবেন। এই প্রস্তাবে সু চি রাজি হননি। আপসহীন সু চি থেকে গেলেন বন্দি। তবে তার পক্ষ থেকে সু চির দুই ছেলে আলেকজেন্ডার এবং কিম নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করেন।
১৯৯২ সালে সু চি ঘোষণা দেন, নোবেল পুরস্কার বাবদ পাওয়া সব অর্থ তিনি মিয়ানমারের স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে ব্যয় করবেন। ১৯৯৪ সালে মুক্তি পান সুচি। কিন্তু মুক্তির স্বাদ পাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে তার ঘরেই তাকে গ্রেফতার করা হয়। সরকার থেকে বলা হয়, আজ থেকে অং সান সু চি গৃহবন্দি। এরপর আর ঘর থেকে বের হওয়া হলো না সুচির।
এমনকি ১৯৯৯ সালে ভালোবাসার মানুষ তার স্বামীর মৃত্যুর পরও তিনি মুক্তি পাননি। সে সময়েও তাকে শর্ত দেওয়া হয়, দেশত্যাগ করলে তিনি ফিরতে পারবেন না। তখনও আপস করেননি তিনি। এমনকি তার গর্ভের দুই সন্তানের সাথেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকে।
বলা হয়, ২১ বছরের রাজনৈতিক জীবনে ১৫ বছরই বন্দি ছিলেন সু চি। অনেকে প্রশ্ন করেন, বন্দি অবস্থায় কীভাবে আন্দোলন হয়? তিনি তো আর আন্দোলন করেননি। আসলে সু চি একটি দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন। গণতন্ত্রের জন্য সব কিছু ত্যাগ করাটাই এক ধরনের আন্দোলন। জীবনের স্বাদ তিনি এই বন্দিত্বের মাঝেই খুঁজে পেয়েছেন। সামরিক জান্তাদের প্রতি এটাই এক ধরনের হুংকার। আর এ নীরবতাই হলো সামরিক জান্তাদের কাল। সু চিকে আটকে রেখে তারা খুব একটা ভালো ছিল না। সবসময় আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ছিল সামরিক সরকার। জনগণের ক্ষোভের মাঝে, অভিশাপের মাঝে কাটাচ্ছে এতোগুলো বছর।
২০০৯ সালে সুচির মুক্তি পাবার কথা ছিল। কিন্তু প্রতিবারই নানান টালবাহানা করে তারা সুচিকে মুক্তি দেয়নি। ২০১০ সালের ১২ নভেম্বর থেকে কানাঘুষা চলছিল, সু চি মুক্তি পাবেন। কিন্তু কেউ নিশ্চিত ছিলেন না। তবে অনেকটা চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত মুক্তি পেলেন গণতন্ত্রের প্রতীক অং সান সু চি।
১৫ বছরের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে সু চি বলে উঠলেন, Do Not Give up Hope....
তিনি আরও বলেন, আমি যতদিন বন্দি ছিলাম ততদিন সিকিউরিটি অফিসাররা আমার সাথে কোনো মন্দ কিছু করেননি। তাই আমি তাদের বলতে চাই, মিয়ানমারের মানুষের সাথেও আপনারা মন্দ করবেন না।
বিবিসির সাথে তাৎক্ষণিকভাবে সাক্ষাৎকারে সু চি বলেন, সবাই কাঁদছেন। এ কান্না তো আনন্দের। কিংবা বলতে পারেন, মুক্তির স্বপ্ন তারা আবার দেখতে শুরু করেছেন। তারা এতদিন অনেক কষ্ট করেছেন। এখন সেই কষ্ট দূর হবে ভেবে তারা আনন্দ উল্লাস করছেন। আমার জন্য তো এ এক পরম পাওয়া যে, তারা আমার মাঝে মুক্তির পথ খোঁজেন।

সামরিক সরকার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি চাই না তাদের পতন হোক। তারা আমাদের দেশেরই সন্তান। আমি এও দেখতে চাই না যে, কোনো বিপ্লবের মাঝে আমার দেশের সেনাবাহিনী পরাজিত হচ্ছে। আমি দেখতে চাই, আমাদের সেনাবাহিনী তাদের দেশপ্রেম দিয়ে অনেক ওপরে উঠে আসছে। তারা তাদের মূল কাজে ফিরে যাবে এটাই আমি আশা করি।
মিয়ানমারে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে বিপ্লব প্রয়োজন কিনা, এমন প্রশ্নের উত্তরে সু চি বলেন, ‘বিপ্লব শব্দটা আমি ব্যবহার করতে চাই না। আগেই বলেছি আমি আমাদের সেনাবাহিনীকে মুখ থুবড়ে পড়তে দেখতে চাই না। তারা আমাদের দেশরক্ষার হাতিয়ার। তারা যদি হেরে যায় তাহলে গোটা জাতি হেরে যাবে। তবে শান্তিপূর্ণভাবেও বিপ্লব সম্ভব। আসল কথা হচ্ছে পরিবর্তন। পরিবর্তন করাটাই বিপ্লব।
আমি জানি না আপনাদের কাছে বিপ্লব মানে কি! তবে আমার কাছে বিপ্লব মানে হলো আমূল পরিবর্তন। অথবা দেখার মতো পরিবর্তন। কারণ, বড় কোনো পরিবর্তনই আপনাকে ভালো কিছু এনে দিতে পারে। আর আমি চাই শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের মধ্যে দিয়েই সেটা হোক। ’
এই সাক্ষাৎকারটি দেওয়ার সময় সু চিকে খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছিল। নিজের ঘরে এতোগুলো বছর বন্দি পার করার পরও সু চি একটুও ভেঙ্গে পড়েননি। তার দল, তার দেশের মানুষ আশায় বুক বাঁধতে শুরু করেছে আবার। সু চি এগুলো জানেন। তার মাধ্যমে দেশের মানুষ মুক্তির স্বপ্ন দেখেন। সুচি এজন্য অহংকার করেন না। তিনি এ প্রসঙ্গে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করেন। তিনি অশ্রুসিক্ত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন বিশ্ববাসীর কাছে। কারণ, শুধু মিয়ানমার নয়, সু চি সারা পৃথিবীরই একজন গণতন্ত্রকামী নেত্রী।
সু চির মতো নেতারা হতাশ হন না। তাই সুচি মুক্তি পেয়েই বলে উঠেছিলেন, ‘ডু নট গিভ আপ হোপ’। যার অর্থ, হাল ছেড়ে দিও না।
বাংলাদেশ সময়: ১৮১০ ঘণ্টা, জুন ৪, ২০১১