ঢাকা, রবিবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৮ মে ২০২৫, ২০ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

নিউ ইয়র্ক থেকে নায়াগ্রা

ড. মাহবুব হাসান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:১১, জুলাই ১০, ২০১১
নিউ ইয়র্ক থেকে নায়াগ্রা

বন্ধুর সঙ্গে ভ্রমণে বেরুলে নাকি বন্ধু চেনা যায়। আর দেশ ভ্রমণ করলে নাকি জানা যায় অনেক কিছু।

আমি বেড়াতে গিয়ে যেমন বন্ধু চিনেছি, তেমনি ভাই-বেরাদরদেরও চিনেছি। আমেরিকায় এসে  চিনলাম আত্মীয়-স্বজনদের। কোনো আত্মীয় আত্মার সোহাগে বরণ করেছে, কোনো আত্মীয় গোস্যা করেছে, কেউবা আমন্ত্রণও জানায়নি। আবার কোনো কোনো আত্মীয় এতো নিস্পৃহ গলায় দাওয়াত দিয়েছে যে মনে হয়েছে আমি যেন এক ভারবাহী বস্তু। ওদের ওখানে না গেলেই ওরা বরং বেঁচে যায়। বন্ধুদের দু-একজন বাদে সবাই আমাকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছে। নিয়ে গেছে তাদের বাড়িতে। রেখেছে কয়েক দিন। আবার পৌঁছেও দিয়ে গেছে জ্যাকসন হাইটসে। এমনই করেছে রশিদ জামান ওরফে শাহান শাহ।

আমেরিকার স্টেটসের সংখ্যা কম-বেশি সবাই জানেন। ৫০-৫১টি রাষ্ট্র মিলে ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা। হয়তো পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম ও দরিদ্র দেশের শিক্ষিত লোকরাও জানেন নিউ ইয়র্ক সিটির নাম। কারণ এই শহর পৃথিবীর অর্থনীতির চালিকাশক্তি বা রাজধানী। কিন্তু কজন জানেন নিউ ইয়র্ক স্টেটের রাজধানী কোথায়? আমিও জানতাম না। আমি মনে করতাম নিউ ইয়র্ক স্টেটের রাজধানীও নিউ ইয়র্ক সিটি বোধহয়! না,নিউ ইয়র্ক সিটি না, সেটা আলবানি সিটি। জানলাম কীভাবে?

লং আইল্যান্ডের বাসা থেকে বেরুতে বেরুতে আমাদের একটু দেরি হয়ে গেলো। শাহান শাহ, শিল্পী ভাবী, ওদের দুই ছেলে আর ছোটো মেয়ে নিয়ে আমরা যখন ভ্যানে উঠি তখন রাত সাড়ে দশটা বেজে গেছে। হোন্ডা কোম্পানির এই ভ্যানগাড়িটা বেশ আরামদায়ক ও সুপরিসর। দূরের রাস্তায় যাচ্ছি, তাই ছোটো কারে যাওয়া ঠিক হবে না। তাছাড়া আমরা সংখ্যায়ও নেহায়েত কম না! কত দূরের পথ ‘নিয়াগারা’ বা ‘নাইয়াগারা’ জলপ্রপাত? আমি এই নামটা বলতে গেলে আবিষ্কার করেছি। নিউ ইয়র্কে আমি উঠেছিলাম জ্যাকসন হাইটসে আমার ভাগনির বাসায়। ওদের দেয়ালে দেখি একটা ছোটো আকারের পোস্টার সাঁটানো। সেখানে নামটা দেখে প্রথমে চমকাইনি। ভেবেছি এটা অন্য কোনো জলপ্রপাত। পরে মিলিয়ে দেখি ঘোড়ার ক্ষুরাকৃতি জলপ্রপাত তো নায়াগ্রাই। আমরা এ নামেই চিনি এই জলপ্রপাতটিকে। কে এই ‘এনআইএজিএআরএ’ বানানের বাংলা করেছে  নায়াগ্রা?
ভাগনি হামিদাকে জিজ্ঞেস করতেই বললো, মামা এটাই তো আসল নাম।

তাহলে আমরা যে জানি এটা নায়াগ্রা, সেটা তাহলে কি নকল?
না, সেটা বাংলা যারা করেছেন তাদের দেওয়া।

মনে পড়লো লন্ডনের বাংলা নাম বিলাত। কতো জনকে বলতে  দেখলাম, বিলাত-ফেরত ব্যারিস্টার। ব্যারিস্টারি পাস করুক না করুক, লোকটা বিলাত-ফেরত, এটাই তো যথেষ্ট। রেণু কাকা নামের আমার এক দূর-সম্পর্কের চাচা বিলাত গিয়েছিলেন গত শতকের ছয় দশকের গোড়ার দিকে। তিনি ব্যারিস্টারি পাস করে ফিরেছিলেন কিনা, কে জানে? বিলাত-ফেরত সেই রেণু কাকা দেশে ফিরে এসে একটি বড়-সড় কোম্পানির জিএমের পদে ঢুকেছিলেন।

লন্ডন যদি বিলাত হতে পারে তাহলে নিয়াগারা ‘নায়াগ্রা’ হলে তো তেমন কোনো দোষের না। এটা তো কোনো বড়রকম চেঞ্জই না। আমি সেই নায়াগ্রা ওরফে নিয়াগারা ফলস দেখতে যাচ্ছি,  জুন মাসের শেষ দিন আজ। কাল ভোরেই পৌঁছে যাবো ফলসের গর্জমান বিশ্বে।

এটাকে আমি এক ধরনের সৌভাগ্যই মনে করছি। কারণ পৃথিবীর এই প্রান্তে পৌঁছে যদি জগৎ-বিখ্যাত জলপ্রপাতটি না দেখি, তাহলে আমেরিকার দেখলামটা কি? শাহান শাহই একদিন বললেন, আপনাকে নায়াগ্রা দেখাতে নিয়ে যাবো আগামী শুক্রবার। তারপর আটলানটিক সিটি। সেখানে আছে বিশাল বিশাল ক্যাসিনো।

কেবল লাস ভেগাসেই সীমাবদ্ধ নয় ক্যাসিনো, নিউইয়র্ক থেকে মাত্র দুই ঘণ্টার ড্রাইভ জর্জিয়ার আটলানটা সিটি। সেখানে তাজমহল নামের সবচেয়ে বড় ক্যাসিনো নাকি দেখবার মতো। নিউ ইয়র্ক থেকে অনেকেই যায় জুয়া খেলতে। আবার কেউ কেউ যায় কেবল দেখতে।
শাহান শাহ বললেন, আমি তো আট/দশ বছর আগে গেছি, নতুন করে দেখা দরকার নায়াগ্রা। শুনেছি ফলসের এলাকার সবচেয়ে পুরোনো পার্কটিকে সাজানো-গোছানো হয়েছে নতুন বিন্যাসে। আমি তো খুশি। তাকে ধন্যবাদ জানালাম আমেরিকানদের ঢংয়ে।
আমরা দু শ মাইল পেরিয়ে এসেছি। রাতও হয়েছে বেশ। শাহান শাহ গাড়ি চালাতে চালাতে হয়তো একটু ক্লান্তি অনুভব করছিলেন।   বললেন, মাহবুব ভাই চলেন আলবানিতে ঢুকে কফি খেয়ে যাই। বললাম, দেরি হয়ে যাবে না? ৫/৬ শ মাইল রান করতে হবে তো। তিনি মানলেন। তা ঠিক, দেরি হবেই। আমি চেয়েছিলাম আপনাকে নিউ ইয়র্কের রাজধানীতে একটু কফি খাওয়াতে। আমারও তো আসা হয় না আর কফির তেষ্টাও পেয়েছে বেশ।
মানে, আমি বিস্মিত! আলবানি!

মানে, নিউ ইয়র্কের রাজধানী যে আলবানি, সেটা আপনি কি জানেন না?

আমি বললাম, কেন নিউ ইয়র্কের রাজধানী নিউ ইয়র্ক না? তিনি মাথা দুলিয়ে বললেন, না। আমি জানলাম নিউ ইয়র্কের রাজধানী কোথায়। এই জানাটা হয়তো বড় কোনো অর্জন নয়, কিন্তু জানাটা/শেখাটা তো  হলো?

রাত সাড়ে ৩টার দিকে আমরা একটি মোটেলে জায়গা পেলাম। তার আগে আরও দুটিতে ঢুঁ মেরে সিট না পেয়ে ফিরে এসেছি। টুরিস্টদের ভিড় লেগেই আছে এই পথের সরাইখানা আর মোটেলগুলোতে। আমেরিকার অন্যান্য স্টেট থেকেও হাজার হাজার মানুষ আসেন নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখতে।

খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে এসেছিলাম বাসা থেকেই। একটু হাত-মুখ ধুয়ে শুয়ে পড়লাম। পরের দিন জাগলাম সকাল আটটায়। আমরা নাশতা খেয়ে রওনা হবো, এটাই ছিলো কথা। তাড়াতাড়ি উঠে বাথ সেরে তৈরি হতে হতেই শাহান ভাই এসে হাজির। বেরিয়ে পড়লাম নাশতার উদ্দেশ্যে। এখানে বেশ কিছু ছবি তোলা হলো। সকাল ১০টায় আবার রওনা হলাম ফলসের দিকে। আমরা এখনো একশ মাইল দূরে আছি। ফলসে পৌঁছাতে এক থেকে দেড় ঘণ্টা লাগবে। আসলেও লাগল ওই রকম সময়ই।

পার্কিংয়ে ঢোকার আগেই চোখে পড়ল কানাডা ঢোকার সীমান্ত গেট। পর্যটকরা এখান দিয়েই ও-দেশে যায় ফলস দেখতে। কানাডা থেকে নাকি ভালো দেখা যায় ফলসের আসল রূপ। শাহান সঙ্গে পাসপোর্ট নিয়ে এসেছেন। কিন্তু আমার তো কানাডিয়ান ভিসা নেই। সেটা এখান থেকেই আগে নিতো সবাই, এখন আর দেয় না। ফলসের রূপে মুগ্ধ হয়ে অনেকেই নাকি আর ফেরে না কানাডা থেকে। এখন ভিসা আনতে যেতে হবে বাফেলোতে। আমরা শনিবারে গেছি বলে বর্ডারের এন্ট্রি বন্ধ। আর বাফেলোতেও বন্ধ। কানাডার ভিসার জন্য মন খারাপ করলাম না।

আমরা প্রথমেই ঢুকলাম ইনফরমেশন সেন্টারে। চমৎকার করে নির্মিত ইনফরমেশন সেন্টার থেকে কিছু বুকলেট নিলাম। তার পর বাগানের বিভিন্ন পথ ধরে মূল ফলসের দিকে এগুলাম। যেতে যেতে শাহান শাহ তুলছেন অনেক ছবি। আমাদের মতো অনেকেই হেঁটেই চলেছেন ফলসের দিকে। আবার ফলসে নিয়ে যাওয়ার জন্য ট্রলি বাস আছে। অনেকেই সেই বাসে চড়ে যাচ্ছেন।

আমরা যতই সামনে এগুচ্ছি ততই জলপ্রপাতের গর্জন বাড়ছে। আমেরিকার পার্টে মূল জলপ্রপাত ছাড়াও আরও দুটি জলপ্রপাত আছে। সেটার একটির ওপর ব্রিজ আছে। সেই ব্রিজ পাড়ি দিয়ে এলাম মূল জলপ্রপাতের সামনের বাগানে। এখানকার বাগানে একটি বিশাল মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। ভদ্রলোকের নামটা এখন আর মনে পড়ছে না। তিনি গরু কিংবা মহিষ হারিয়ে ফেলেছিলেন। সেই পশুকে খুঁজতে খুজতে তিনি এসেছিলেন নিয়াগারা জলপ্রপাতের ধারে। গর্জমান পানি পতনের শব্দ শুনে তিনি এগিয়ে এসেছিলেন ফলসের গোড়ায়। এখানে যে একটি ফলস আছে, সেটা তার আগে কেউ জানত না। নিয়াগারা নদীটির উৎস কানাডায়। সে আমেরিকায় ঢুকে বেশ কিছু এলাকা ঘুরে নিয়ে আবার আমেরিকা-কানাডা বর্ডার দিয়ে ভাটিতে গেছে। সেই ভাটি আবার আমেরিকার প্রান্ত ছুঁয়ে নেমে গেছে সমুদ্রে। ফলসের সামান্য আগেই নিয়াগারার রূপ অনেক শান্ত, সমাহিত এবং ছড়ানো। এখান থেকেই শাখা ফলস বেরিয়েছে। ফলসের জায়গাটা সরু বলে সমস্ত পানির চাপ এসে এখানে জমে এবং যখন সেই পানি এক-দেড়শ ফিট নিচে পড়ে, তখন তার শব্দ এমন হয় যে তাতে অনেকের হৃদকম্প হয়। গর্জমানতার ভেতরে বেশিক্ষণ থাকা যায় না। আমরা বেশ কিছু ছবি তুলে জলপ্রপাতের সঙ্গে নিজেদের মিলিয়ে-মিশিয়ে নিলাম। এগুলোই আনন্দের অংশ। ব্যক্তিগত ইতিহাসের উপকরণ। আমার মনের ভেতরে একরকম আনন্দ তিরতির করে আমাকে নাচিয়ে নিয়ে চলেছে। আমরা তাই ছবি-টবি তুলে এলাম ‘কেইভ অব দ্য উইন্ডসে’। জনপ্রতি ১১ ডলারের টিকিট কেটে নামলাম নিচে লিফটে করে। আমাদের দেওয়া হলো স্পঞ্জের জুতো আর পলিথিনের হলুদ রঙের ফুল সাইজ জ্যাকেট। যাতে ভিজে না যাই, সেজন্য এই ব্যবস্থা।   কেইভের ভেতর দিয়ে গিয়ে পড়লাম নদীর ধারে। সেখানে রক বা পাথরের ওপরে পড়ছে ফলসের অজস্রধারা। সেখানে উপরে উঠার জন্য তৈরি করা হয়েছে কাঠের সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি ধরে অনেকেই এগিয়ে যাচ্ছেন। শিল্পী ভাবী মেয়েকে কোলে নিয়ে এক ধাপ গিয়ে প্রচ- বাতাসের পড়ে যাবার ভয়ে ফিরে এলেন। আমরা তাকে বললাম পেছনের দিকে দাঁড়াতে। আমি শাহান শাহ ওর দুই ছেলে পর্যায়ক্রমে ধাপগুলো পেরিয়ে আবার নেমে এলাম অন্যদিক দিয়ে। এতে আমাদের প্যান্টের নিচের অংশ ভিজে গেলো। ভেজার হাত থেকে বাঁচানোর জন্যই পলিথিনের জ্যাকেট দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি তেমন।

এই কেইভে ঢোকার অভিজ্ঞতা অন্যরকম। ভয় এবং আনন্দ একই সঙ্গে আমাকে নতুন অভিজ্ঞানে পৌঁছে দিয়েছিলো। মনে হয়েছিলো ফলসের পানির তোড়ে পড়ে যাবো। সামান্য পানির ছিটে এসে লাগে, কিন্তু বাতাস প্রচ-। সেই বাতাসে মনে হয় উড়ে যাবো। এই অভিজ্ঞতার পর আর মূল ফলসের নিচে জাহাজে করে যাওয়ার সাধ থাকলো না। আমি মনে মনে বললাম, আল্লাহ যদি আবার কোনোদিন সুযোগ দেন, তাহলে তখন ফলসের নিচে যাবো।

বাংলাদেশ সময় ২০৫৫ ঘণ্টা, জুলাই ১০, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।