ঢাকা, রবিবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৮ মে ২০২৫, ২০ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

করিমের কেঁচো চাষ : সৌভাগ্যের সিঁড়ি

জুলফিকার আলী কানন, মেহেরপুর জেলা প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০:৫৫, জুলাই ১৬, ২০১১
করিমের কেঁচো চাষ : সৌভাগ্যের সিঁড়ি

মেহেরপুরের রঘুনাথপুর আশ্রয়ন প্রকল্পের একসময়ের বাসিন্দা হতদরিদ্র করিম এখন কারো করুণার পাত্র নন। এখন তিনি আর সরকারের দেওয়া গুচ্ছগ্রামে বাস করেন না।

বরং কেবল কেঁচো চাষ করেই তিনি সমাজের লাখপতিদের তালিকায় নাম লিখিয়ে নিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে করিম শুধু নিজেই সাবলম্বী হননি, সমাজের অবহেলিত কৃষকদের মাঝেও সাড়া জাগিয়েছেন।

করিমের কেঁচো সার বদলে দিয়েছে মেহেরপুর জেলার অনেক কৃষকেরও ভাগ্য। তবে শুধু মেহেরপুরেই নয়, এখন দেশের বিভিন্ন জেলার কৃষকরা এই সার ব্যবহার করে যেমন মাটির উর্বরতা বাড়াচ্ছেন, তেমনি কীটনাশকের বিষ থেকেও বাঁচাতে পারছেন পরিবেশ।

একটা সময় ছিল যখন মাটি খুঁড়লেই কেঁচো বেরুতো। বর্ষায় যত্রতত্র কেঁচো দেখা যেত। এই কেঁচো জমির উর্বরাশক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি মাটিতে জৈবসার তৈরি করত। তখন প্রকৃতিগতভাবেই জন্ম নিত এই কেঁচো। কিন্তু জমিতে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরাশক্তি হ্রাসের পাশাপাশি কেঁচোও বিলুপ্ত হতে চলেছে। তাই এখন রাসায়নিক সারের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে কৃষিকে রক্ষার জন্য কেঁচোর চাষ করতে হচ্ছে। গোবর থেকে নির্গত কেঁচোর মলই এখন চাষাবাদের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মানের জৈব সার, যা কেঁচো সার হিসেবে পরিচিত। গোবরে এই কেঁচো চাষ করে তৈরি সার এখন যেমন লাভজনক, তেমনি পরিবেশ ও কৃষিবান্ধব ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই অনন্য কাজটিই করছেন মেহেরপুরের ভূমিহীন চাষী আবদুল করিম (৫৫)। তিন বছর আগে ভারত থেকে ৭ হাজার কেঁচো এনে তা চাষ করে এখন তার ৫ লাখ কেঁচো। মাত্র ২০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে কেঁচো চাষ করে এখন তিনি লাখপতি। প্রতি মাসে যেমন লাখ টাকার কেঁচো বিক্রি করেন, তেমনি কেঁচো দিয়ে তৈরি জৈবসারও বিক্রি হয় প্রায় লাখ টাকার। ফলে স্বল্প পুঁজিতে কেঁচো চাষ করে নিজের এবং চাষীদের জীবন বদলে দিয়েছেন করিম।

যেভাবে শুরু

 ঊবা-মা মারা যাওয়ার পর ২০০০ সালের বন্যার সময় মেহেরপুরের গোপালপুর গ্রাম ছেড়ে ভূমিহীনদের জন্য গড়া আমঝুপির রঘুনাথপুর আশ্রায়নে ঠিকানা গড়েন করিম। তখন অন্যের একবিঘা জমি লিজ নিয়ে চাষাবাদের পাশাপাশি শ্রম বিক্রি করে জীবন চালাতেন। এভাবে ২০ হাজার টাকা পুঁজি হলে তার ইচ্ছা হয় আরও দুই বিঘা জমি লিজ নিয়ে চাষাবাদ করার। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে (২০০৭ সালে) সার ও বীজের তীব্র সংকট দেখা দিলে সে বছর অনাবাদি থাকে তার জমি। তখন মেহেরপুর সদর কৃষি অফিসের স্থানীয় ব্ল¬ক সুপারভাইজার আশরাফুল ইসলাম তাকে লালা (লাল) জাতের কেঁচো সংগ্রহ করে তা গোবরে চাষ করে জৈবসার তৈরির পরামর্শ দেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পর ২০০৭ সালের অক্টোবরে ভারতের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর থানার শাšিপুরে ২০ দিন থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ৫ হাজার টাকায় ২০ হাজার কেঁচো কিনে আনেন। সেখানে অধিকাংশ বাড়িতেই কেঁচো দিয়ে জৈবসার তৈরির ফলে পশ্চিমবঙ্গের জমিতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমে গেছে বলে জানান সে। তখন এই কেঁচোর প্রজনন বিস্তার ও জৈবসার তৈরির জন্য ১২ হাজার টাকায় একটি গাভী কেনেন। শুরু হয় গোবরে কেঁচো চাষ করে জৈবসার তৈরির কাজ। এই কেঁচোগুলি লাল রংয়ের। এর নির্গত গোবর মলই জৈবসার। এগুলো দেখতে গুটি চায়ের দানার মতো লালচে কালো। প্রথমে লিজ নেওয়া জমিতে এই সার ব্যবহারে ফসলের বাড়তি ফলন দেখে দ্রুত দৃষ্টি কাড়ে আশপাশের চাষীদের। বাড়তে থাকে কেঁচো ও কেঁচো সারের চাহিদা। শীতকাল ছাড়া সব সময় এই কেঁচো বাচ্চা দেয়। কেঁচোর একটা ডিম থেকে বিশটির বেশি বাচ্চা হয়। এভাবেই বেড়েছে তার কেঁচোর সংখ্যা ও জৈবসার উৎপাদনের পরিমাণ। এর ফলে মাত্র দুই বছরে ভূমিহীন চাষী থেকে তিনি এখন লাখপতি করিম।


করিম ও তার পরিবারের কথা

 আবদুল করিম বাংলানিউজকে জানান, ২০ হাজার কেঁচো থেকে এখন তার ১০ লাখ কেঁচো। এর আগে ১ লাখ কেঁচো ৩ লাখ টাকায় বিক্রি করেছেন। প্রতিটি কেঁচোর দাম ৩ টাকা হিসেবে তার ১০ লাখ কেঁচোর দাম ৩০ লাখ টাকা। পাশাপাশি প্রায় ১ লাখ টাকার কেঁচো সারও বিক্রি হয়েছে। এই অর্থ দিয়ে তিনি ৫ টি গরু কিনেছেন। এখন সে গরুর দাম প্রায় ৩ লাখ। এখন তিনি প্রায় ২০ বিঘা জমি বন্ধকে এবং ১০ বিঘা জমি লিজ নিয়ে চাষাবাদ করছেন। এখন তাকে আর সার কিনতে হয় না। স্ত্রী যমুনা খাতুন (৪০) ও ছেলে শরীফুল ইসলাম (২৩) কেঁচোর পরিচর্যা ও কেঁচো সার উৎপাদনকেই পেশা হিসেবে নিয়েছেন। দুই মেয়ে বিবাহিত। ছোট মেয়ে আজমিরা খাতুন আমঝুপি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে।

তারা বাংলানিউজকে জানান, যে গরুতে দুধ দেয়, তার লাথি খেতেও ভালো লাগে। তাই সারা দিন কেঁচো নাড়াচাড়া করতে তাদের খারাপ লাগে না, বরং মনে হয় যেন সারা দিন তারা পয়সা নাড়াচাড়া করছেন। ঢাকা গুলশানের গোলাম আজমের মতো দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এখন করিমের কেঁচো ও জৈবসার কিনতে প্রতিদিন অনেকে আসছেন তার বাড়িতে।

করিম জানান, গরুর সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি গোবরের পরিমাণ বাড়লে তাতে অধিক সংখ্যক কেঁচো চাষ করে জৈবসার তৈরি করা যাবে। এখন তার ৫টি গরুতে প্রতি ১৫ দিনে ৭ মণ সার হয়। প্রতি মণ সারের দাম ৮০০। সে হিসেবে প্রতি ১৫ দিনে তিনি সাড়ে ৫ হাজার টাকার সার বিক্রি করেন।

অন্যদের কথা

করিমের জৈবসার ব্যবহারকারী আমঝুপি ইউনিয়নের চাষী আলামিন হোসেন, জাহিদুর ইসলাম, শাহজাহান আলী, কাওসার আলী ও আশরাফুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, তারা এখন জমিতে রাসায়নিক সারের বদলে করিমের কেঁচো সার ব্যবহার করেন। এতে খরচ সাশ্রয় ও জমির উর্বরাশক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি ফসলের পুষ্টিমানও বেড়েছে বহুগুণ।

তারা জানান, রাসায়নিক সার প্রতি বছর প্রত্যেক ফসলে ব্যবহার করতে হয়। অন্যদিকে জৈবসার একবার ব্যাবহার করলে অন্যবার দিতে হয় না। এই সার ব্যবহারে জমি ঠা-া থাকে। ফসলের পাতা শক্তিশালী হয়। আবার ফসলের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ে।

আমঝুপি হিজুলী গ্রামের কৃষক রাশেদুল ইসলাম বলেন, তার গ্রামের অধিকাংশ কৃষক এখন এই জৈবসার ব্যবহার করছেন এবং তারাও গোবরে কেঁচোর চাষ করে জৈবসার তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

আমঝুপি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম বাংলানিউজকে  বললেন, করিমের জৈবসার এ অঞ্চলের মাটি ও কৃষককে বাঁচিয়েছে। অর্থাভাবে তিনি চাহিদামতো সার এই মুহূর্তে না দিতে পারলেও তার ইচ্ছাশক্তি ও পরিশ্রম তাকে লক্ষ্যে নিয়ে যাবে।

মেহেরপুর সদর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা জাহিদুল আমিন বাংলানিউজকে বলেন, একটি আদর্শ মাটিতে ৫ ভাগ জৈব উপাদান থাকে। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারে মেহেরপুরের মাটিতে এখন জৈব উপাদান আছে মাত্র ১ ভাগ। অথচ গোবরে চাষ করা করিমের কেঁচো সারে জৈব উপাদান আছে ৩০ ভাগ। আবার এই সারে মাটির আরও ১০ ধরনের খাদ্য উপাদান থাকায় ফসল বাড়ার সাথে ফসলের পুষ্টিমানও বাড়ছে।

তিনি আরও জানান, আমঝুপি ইউনিয়ন পরিষদের সহায়তায় মেহেরপুর সদর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ প্রতিটি ওয়ার্ডে করিমের মতো করে কেঁচো সার উৎপাদনের ভাটি (বেড) তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছে। দেশের কয়েক জেলায় আর্বজনা পচিয়ে কেঁচো সার তৈরি করা হলেও একমাত্র করিম গোবরে কেঁচো চাষ করে উৎকৃষ্ট মানের কেঁচো সার (জৈব সার) তৈরি করছেন, যা দেশের মডেল ও পরিবেশবান্ধব। এ সার ব্যবহারে চাষীর উৎপাদন খরচ যেমন বহু গুণ কমছে তেমনি ফসল উৎপাদনও কয়েক গুণ বাড়ছে বলে তিনি দাবি করেন।


চাষ ও উৎপাদন বাড়াতে চান করিম

দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য করিম নদীয়া জেলার তেহট্ট থানার নজিরপুর গ্রামের এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ইন্তাজ বিশ্বাসের কাছে কিছুদিন প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তার ইচ্ছা আরও বড় পরিসরে কেঁচোর চাষ করার। এক্ষেত্রে সরকারি অর্থ সহযোগিতা পেলে একটা মেশিন কিনে এই জৈব সারকে গুটি সার বানিয়ে প্যাকেটজাত করে বিপণন করার ইচ্ছা রয়েছে তার। তিনি বলেন, সব কৃষকের বাড়িতে এভাবে জৈব সার তৈরি হলে কৃষকের ভাগ্য যেমন বদলাবে, তেমনি জমির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি বদলাবে ফসলের পুষ্টিমান। তখন রাসায়নিক সারে উৎপাদিত বিষমিশ্রিত ফসল আর কাউকে খেতে হবে না। একজন কৃষক ১১০০ টাকা খরচ করে একটা ভাটি (বেড) গড়ে এই পদ্ধতিতে জৈবসার তৈরি করলে তা দিয়ে নিজের জমির সারের চাহিদা মেটানো সম্ভব।

বাংলাদেশ সময় ২০৪০ ঘণ্টা, জুলাই ১৬, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।