ঢাকা, রবিবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৮ মে ২০২৫, ২০ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

সোহাগ পরিবহনের এগিয়ে চলা

আহ্সান কবীর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:১১, জুলাই ১৯, ২০১১
সোহাগ পরিবহনের এগিয়ে চলা

বলা হয় খাদ্যদ্রব্য, চিকিৎসা আর পরিবহন সংক্রান্ত ব্যবসাগুলো আর দশটা ব্যবসার মত স্রেফ ব্যবসা নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে জনসেবার একটি অন্তর্নিহিত স্পিরিটও।

এক্ষেত্রে বাংলাদেশে যাত্রী পরিবহন জগতে বিরাজমান নানান নৈরাজ্য আর অব্যবস্থার মধ্যেও যে ক’টি প্রতিষ্ঠান নিজেদের কর্মতৎপরতা আর সেবাধর্ম দিয়ে গ্রাহকদের মন জয় করে ‘নির্ভরযোগ্য আপনজনে’ পরিণত হয়েছে, সোহাগ পরিবহন তাদের পথ প্রদর্শক।

তবে যেমন বলা হয় `Rome was not built in a day` তেমনি সোহাগ পরিবহনও একদিনে এ অবস্থানে পৌঁছেনি। দেশের যাত্রী পরিবহন সেক্টরে আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল সোহাগ পরিবহনের ব্যাপারে পাঠক ও সাধারণ মানুষের ব্যাপক আগ্রহের কারণে সম্প্রতি আমরা তাদের বিষয়ে আরো জানতে আগ্রহী হই।

কয়েকটি টিভি চ্যানেলে সোহাগের গতি আর গীতিময় বিজ্ঞাপনটি দেখে সাধারণ্যে এ আগ্রহের মাত্রা আরো বেড়েছে। সোহাগ পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক সোহেল বাংলনিউজকে জানিয়েছেন অন্যদের জন্য প্রেরণাদায়ী তার সংগ্রাম ও সাফল্যের গল্প।  

যেভাবে শুরু
১৯৭৩ সালে সোহাগ পরিবহন সংস্থা নামে আজকের দেশখ্যাত সোহাগ পরিবহনের যাত্রা শুরু। উদ্যোক্তা ছিলেন মাহমুদ ইউনুস তালুকদার। বড় ছেলে সোহাগের নামানুসারে চালু করা এই প্রতিষ্ঠানটিকে সাফল্যের সঙ্গে দেশের আন্তঃজেলা সড়ক পরিবহনে যাত্রী সেবায় প্রতিষ্ঠিত করার এক পর্যায়ে মাহমুদ সাহেব ১৯৮৬ সালে ইন্তেকাল করেন। এরপর সোহাগ পরিবহন সংস্থার দায়িত্ব নেন তার ৪ ছেলে। ১৯৮৭ সালে মেজ ছেলে ফারুক তালুকদার সোহেলের নেতৃত্বে সোহাগ নব উদ্যমে যাত্রা শুরু করে।
 
বর্তমানে সোহাগ গ্রুপ নামে পরিচিত প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারপারসন হচ্ছেন মরহুম মাহমুদ ইউনুস তালুকদারের স্ত্রী আনোয়ারা বেগম। আর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেজ ছেলে ফারুক তালুকদার সোহেল। আর বড় ছেলে সোহাগ ও বাকি ৩ ভাই হচ্ছেন পরিচালক।

১৯৯২ সালের ২ ডিসেম্বর দেশের যাত্রী পরিবহন জগতের  সনাতন ধ্যান-ধারণায় এক বিপ্লব ঘটান ফারুক সোহেল। শুরু হয় এই সবুজ শ্যামল বাংলার সড়ক পথে সম্পূর্ণ এয়ার কন্ডিশন্ড যাত্রীবাহী কোচের শুভযাত্রা। কিন্তু সূচনাকালটা অন্যান্য অনেক বৃহৎ ও যুগান্তকারী উদ্যোগের মতই কুসুমাস্তৃর্ণ ছিল না। টেলিভিশনসহ অন্যান্য প্রচার মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে শুরু করার পরও দেখা গেল যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে না। প্রায়ই দেখা যাচ্ছে ট্রিপগুলো রওনা হচ্ছে অনেকটা যাত্রীবিহীনভাবে।

ফারুক সোহেলের তখন মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার অবস্থা। তার মনে হলো, `মোটা অংকের আনুষঙ্গিক খরচসহ বিলাসবহুল এসব উচ্চমূল্যের গাড়ি এনে কি তাহলে ফেঁসে গেলাম! অন্যদের কাছে হাসির পাত্র হয়ে পড়বো? `

এ প্রসঙ্গে ফারুক সোহেল জানান, একজন ব্যবসায়ী হিসেবে তার ধ্যান-ধারণা ছিল সব সময়ে অন্যদের সামনে দৃষ্টান্তমূলক কিছু উপস্থাপন করা। কিন্তু এসি বাস চালু করে দেখা গেল পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন।

তবে কি গিয়ার উল্টো লেগে গেল!

এই হতাশা আর পেরেশানির সময়ে ছেলের পাশে এগিয়ে এলেন মা আনোয়ারা বেগম। মহিয়সী এই নারী তার দ্বিধাগ্রস্ত পুত্রকে আশার বাণী শোনালেন। হাজারো বছর ধরে মানবের পথচলায় এ ধরণের বিপর্যয়কর পরিবেশে একান্ত শুভাকাঙ্ক্ষীরা যে ঐশ্বরিক বাণীতে উদ্বুদ্ধ করেছেন দিগ্বিজয়ী যোদ্ধাদের, তাই শোনালেন তিনি ছেলেকে।

বললেন- `বাবা, দুঃখের দিনে ভেঙ্গে পড়ো না। কাজ করে যাও, একদিন সফল তুমি হবেই। আজ তুমি যা শুরু করেছো- তাকে যদি শক্ত করে ধরে রাখ, তাহলেই সফল হবে। আর যদি কোনও কারণে এপথে সাফল্য নাও আসে, যদি ব্যর্থও হও, তবে এ ব্যর্থতার পথে যা শিখবে তা তোমার পরবর্তী উদ্যোগকে সাফল্যের সোপানে নিয়ে যাবে`

 

মায়ের সেদিনকার কথাগুলো বলতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছিলেন ফারুক সোহেল।

‘পরদিন সকাল থেকেই আমার জগৎ সম্পূর্ণ অন্য এক রূপে ধরা দিল। মা’র কথায় কী যাদু ছিল জানি না! কিন্তু আমি প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম কাজে। ফল ধরা দিল অল্প দিনেই। দেখলাম, সোহাগের কাউন্টারে এসি বাসের টিকেট কাটছেন যাত্রীরা লাইন ধরে। অথচ মাত্র ক’দিন আগেও যাত্রী পাচ্ছিলাম না আমরা!’

ফারুক সোহেল বললেন, ‘এসি বাস নিয়ে এত কথা বলার কারণ এটার সাফল্য পরবর্তীকালে নিত্য নতুন পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করেছে সোহাগ পরিবহনকে। ’

তিনি জানালেন, সোহাগের প্রতিটি কাউন্টারকে আন্তর্জাতিক মানের যাত্রীসেবার উপযোগী করে গড়ে তোলা হচ্ছে। বেশ ক`বছর ধরে চালু রয়েছে অনলাইনে টিকিট পাওয়ার সুবিধা; যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে প্রথম। এ সুবিধার ফলে গ্রাহকরা নিজের সুবিধামত স্থান থেকে ঝামেলা এড়িয়ে ইন্টারনেটে টিকেট বুকিং দিতে পারেন।

একইসঙ্গে অন্য অনেক পরিবহনের মত একই সিট দু’তিনজনের নামে বরাদ্দের ঝামেলা ও অপ্রীতিকর পরিস্থিতি পোহাতে হয় না যাত্রীসাধারণকে।

ফারুক সোহেল বললেন, ‘এছাড়া আগামী ১৫-২০ দিনের মধ্যে স্পেশাল একটি সার্ভিস চালু করতে যাচ্ছি।   এ সার্ভিসটির মাধ্যমে আমরা এসএমএসের মাধ্যমে টিকিট বুকিং সেবা চালু করতে যাচ্ছি। ’

অন্যরা একধাপ এগোন, সোহাগ কয়েক ধাপ

টিকেটিং এবং বাহনগুলোর পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণে সোহাগই প্রথম শুরু করে নিজস্ব ওয়্যারলেস কমিউনিকেশন ব্যবস্থা। আন্তঃজেলা কোচে সনাতন সুপারভাইজার বা কন্ট্রাক্টর ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন  করে  শিক্ষিত ও মার্জিত গাইড পদ্ধতির প্রবর্তনেও তারাই পাইওনিয়ার।

সোহাগের গাইড থেকে নিয়ে ড্রাইভার ও অন্যান্য স্টাফ প্রত্যেকের জন্য রয়েছে বিভিন্ন ধরণের মানোন্নয়ন ও ওরিয়েন্টেশন কোর্সের ব্যবস্থা। যাত্রীদের সমস্যা দূরীকরণ ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির ব্যাপারে স্টাফদের মধ্যে সরাসরি অভিজ্ঞতা বিনিময় ও কর্তৃপক্ষীয় পদক্ষেপে সহায়তার জন্য আয়োজন করা হয় গ্রুপ ডিসকাশনের। এতে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীসাধারণের মূল চাহিদাগুলো সম্পর্কে তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায় ও ব্যবস্থা নেওয়া যায়। আর এভাবেই বিরামহীন সাফল্যের পথ বেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সোহাগ। অন্যরা যখন একধাপ এগোন, সোহাগ এগিয়ে যায় কয়েক ধাপ।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৪১ ঘণ্টা, ১৯ জুলাই, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।