ঢাকা, রবিবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৮ মে ২০২৫, ২০ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

হিটলার আন্দোলনে সোফিয়ার আত্মত্যাগ

একেএম ফয়জুল ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬:৫৮, আগস্ট ১, ২০১১
হিটলার আন্দোলনে সোফিয়ার আত্মত্যাগ

ইতিহাসের স্বৈরাচারী শাসক হিসেবে হিটলারের নাম চলে আসে সবার আগে। এ শাসকের আমলে বেশ কয়েকটি ঘরোয়া বিপ্লব হয়।

এর মধ্যে সোফিয়ার বিপ্লব পুরো জামার্নিতে হিটলার সরকারকে কঠিন আন্দোলনের তোপে ফেলেছিল।

ইতিহাসে এমনই এক বিপ্লবী সোফিয়া স্কল। বিষ্ময়কর হলো সোফিয়া ২১ বছরের এক তরুণী। যিনি শুরুতে হিটলারের পক্ষে থাকলেও পরে হিটলারের বিপক্ষে আন্দোলন শুরু করেন।

দেশে স্বাধীনতা প্রয়োজন এবং হিটলারের হাত থেকে জার্মানদের মুক্তি খুবই প্রয়োজন বলে মনে করেন সোফিয়া। হিটলারকে উৎখাতের স্বপ্ন নিয়ে বিপ্লব করতে চেয়েছিলেন সোফিয়া ও তার বন্ধুরা।

সোফিয়া স্কল ছিলেন জার্মানির ফোর্টেনবার্গের মেয়রের মেয়ে। বাবা-মায়ের ছয় সন্তানের মধ্যে চতুর্থ সোফিয়া।

জন্ম ১৯২১ সালের ৯ মে। ১৯৩৩ সালে তাদের পরিবার যখন ‘আল্ম’-এ চলে আসে তখন তিনি হিটলারের যুব সংঘে যোগ দেন। প্রথমে এ সংঘ নিয়ে খুব আগ্রহ থাকলেও পরে তিনি বুঝতে পারলেন, ক্রমেই হিটলার এবং তার সরকার বিতর্কিত হয়ে পড়ছে।

সোফিয়ার ভাই হ্যান্স স্কলও হিটলার বাহিনীর সদস্য ছিল। কিন্তু কিছুদিন পর সে তার বিতর্কিত কার্যকলাপের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে জেলে যায়।

১৯৪০ সালে স্কুল জীবন শেষের পর সোফিয়া শিক্ষক হিসেবে একটি কিন্ডারগার্ডেন স্কুলে কাজ শুরু করেন। ১৯৪২ সালের মে মাসে তিনি ভর্তি হন ইউনিভার্সিটি অব মিউনিখে। তিনি ছিলেন জীববিদ্যা ও দর্শনের শিক্ষার্থী।  

হিটলারের নানা ধরনের কার্যকলাপ দেখে ধীরে ধীরে সোফিয়ার মন বিরূপ হতে থাকে। তবে যে ঘটনাটি তার হৃদয়ে বিপ্লবী চেতনা তৈরি করে সেটি বলা যাক। একদিন তার বাবা একজনকে বলছেন, ‘ হিটলার হচ্ছে ঈশ্বরের চাবুক। যদি দ্রুত যুদ্ধ শেষ না হয় তাহলে এক সময় রাশিয়ানরা বার্লিনের উপনিবেশ হয়ে যাবে। ’

এ একটি বক্তব্যই সোফিয়াকে ভাবতে শেখায়। তিনি হিটলারের যুদ্ধকে অনৈতিক বলে মনে করতে থাকেন।

তিনি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন ঠিক সেই সময় তার ভাই হ্যান্সও ছিল ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে।   সে গঠন করেছিল ‘হোয়াইট রোজ গ্রুপ’ নামে একটি যুবসংঘ। যে সংঘের সবাই তৎকালীন হিটলার সরকারের উৎখাতের বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল।  

এ সংঘে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের একজন শিক্ষক ছাড়াও আরো কয়েকজন সদস্য সক্রিয় ছিলেন। এক সময় গিয়ে সোফিয়াও ‘হোয়াইট রোজ গ্রুপ’-এ যোগ দিলো। এ যুবসংঘ বিশ্বাস করত, জার্মানির যুবসমাজই হিটলার ও তার সরকারের পতন ঘটাতে পারবে।

সংঘের সদস্যরা ঠিক করলেন তারা তাদের দেশের গণতন্ত্র ও সামাজিক বিচার ফিরিয়ে আনার আন্দোলন করবে। এ জন্য সকলকে সচেতন করতে তারা দেশব্যাপী জনগণের মধ্যে লিফলেট বিতরণ করবেন।

সংঘের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সোফিয়া লিফলেট বিতরণ শুরু করে দিলো। প্রথমে বেনামে লিফলেট বিতরণ করা হতো। পরে লিফলিটে সংঘের নাম সংযুক্ত করা হলো।    

এ সংঘ গঠনের কারণ হিসেবে উল্লেখ ছিল, ‘আমরা চেষ্টার মাধ্যমে প্রমাণ করতে চাই, সবাই যার যার অবস্থান থেকে বর্তমান নাশকতার বিরুদ্ধে অংশ নেবে। এটা সম্ভব। দৃঢ় বিশ্বাসী ও উদ্দ্যমী জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই সম্ভব হবে। এ গ্রুপের লক্ষ্য হলো, জাতীয় সমাজতন্ত্রকে উপর থেকে নিচে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া এবং এ সংগ্রামে আমরা অবশ্যই আমাদের কার্যকলাপ এবং আক্রমণ থেকে পিছ পা হবো না। এ যুদ্ধে বিজয় নিশ্চিত। ’

এছাড়াও তারা বিভিন্ন ভবনের দেওয়ালে লিখন শুরু করলো। লুকিয়ে লুকিয়ে তারা লিখত, ‘হিটলারের পতন চাই’, ‘হিটলার খুনি’ এবং ‘স্বাধীনতা চাই’ এ ধরনের বিপ্লবী বাক্য।

১৯৪৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারিতে সোফিয়া ও তার ভাই হ্যান্স তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে লিফলেট বিতরণ করছিল। এ সময় হিটলার দলের সদস্য জ্যাকব তাদের দেখে ফেলে। জ্যাকব দ্রুত তৎকালীন বিশেষ গুপ্ত পুলিশদের খবরটি পৌঁছে দেয়। তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেফতার করা হলো সোফিয়া ও হ্যান্সকে।

২১ ফেব্রুয়ারি আদালতে সোফিয়ার শিরোচ্ছেদ করা হবে বলে রায় দেওয়া হলো। রায়ের আগে তিনি বলেছিলেন,  
‘কাউকে না কাউকে তো বিপ্লব শুরু করতে হবে। আমাদের লিফলেটে যা আমরা বলতে চেয়েছি তা আমাদের দেশের প্রতিটি মানুষ বলতে চায়। আমি মনে করি, আমাদের দেশের প্রতিটি মানুষ এগুলো বিশ্বাস করে। তারাও বলতে চায়। কিন্তু আমাদের মতো পরিণতির ভয়ে তারা তাদের মনের কথাগুলো প্রকাশ্যে বলতে পারছে না। তবে আমি মনে করি এ বিপ্লব থেমে থাকবে না। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক। স্বাধীনতা আসন্ন। ’

২২ ফেব্রুয়ারি সোফিয়ার শিরোচ্ছেদ কার্যকর করা হয়।

সোফিয়ার সম্মানে ২০০৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি জার্মানির ব্যাভারিয়া রাজ্যে সরকারি উদ্যোগে তার মূর্তি বানানো হয়।

ইতিহাসে সোফিয়ার নাম খুব একটা উচ্চারিত হয় না। তবে সত্যি কথা হলো, সে সময়ের তরুণদের মাঝে সোফিয়ার আন্দোলন ব্যাপকভাবে সাড়া ফেলে দেয়। এমনকি তার মৃত্যুর পর তার সংঘের সদস্যরা বিপ্লবের উদ্দেশ্যে সারা জার্মানে ছড়িয়ে পড়ে । হিটলারের বিরুদ্ধে বিপ্লবকে উসকে দিয়েছিল সোফিয়া স্কলের মৃত্যু।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫০ ঘণ্টা, ১ আগস্ট, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।