ক্লোজআপ ওয়ান তারকা শিল্পী আবিদ শাহরিয়ার নেই। আবিদের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে রহস্যময় সমুদ্র।
বন্ধু দিবসে আবিদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু রেহনুমা ভাবনা লিখেছেন বন্ধু আবিদকে নিয়ে তার স্মৃতিকথা।
১৪ মার্চ, ২০০৫। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের প্রথম ক্লাস শেষে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি আমি আর নিশাত। পরের ক্লাসটা ৩ ঘণ্টা পরে। এতো সময় কি করবো চিন্তা করছি। হঠাৎ একটি ছেলে এসে আমাদের জিজ্ঞেস করল, ‘এতোটা টাইম কি করবে? চলো ক্রিকেট খেলতে যাই। ’
আমরা দুজন এতই অবাক হলাম যে মনে মনে ভাবলাম, ছেলের মাথা ঠিক আছে তো? তার পাশেই দেখলাম আরেকটা ছেলে দাড়িয়ে আছে। আমি হাসতে হাসতে বললাম, ‘ধন্যবাদ, কিন্তু আমরা তো এখন লাঞ্চে যাবো। ’
এরপর প্রায় এক মাস আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া হয়নি। চিকেনপক্স হয়েছিল। ফিরে এসে দেখলাম সেই দুটি ছেলে আমাদের গ্রুপের সদস্য। মানে আমাদের বন্ধুদের সাথে তাদের ঘনিষ্ঠতা বেড়ে গেছে।
তখন গ্রুপ স্ট্যাডি হতো। তখন শুধু জানতাম ছোট খাটো করে ছেলেটার নাম আবিদ। আবিদ নাকি ভালো গানও গেতে পারে। এর কিছুদিন পরই ক্লোজআপ-ওয়ান প্রতিযোগিতায় টিকে যায় আবিদ। তখনি প্রথম আবিদের গান শুনি। এতো অবাক হয়েছিলাম ওর গান শুনে যে এ মুহূর্তে বোঝাতে পারবো না। এতো সুন্দর গানের গলা!!
সত্যি কথা বলতে কি, শুধুমাত্র ওর কারনেই আমি রবীন্দ্রসংগীত শুনতে শুরু করেছিলাম। যে ছেলেটির গান আগে শুনিনি; সেই ছেলেটির জন্য আমরা সবাই পাবলিসিটি শুরু করি। ক্লাসে ক্লাসে গিয়ে ভোট চাই। টিচারদের কাছে, বড় ভাইদের কাছে গিয়ে সহযোগিতা চাই। এভাবেই খুব অল্পদিনের মধ্যেই আবিদ আমাদের অনেক কাছের বন্ধু হয়ে যায়।
আমি, আবিদ, নিশাত, তিন্নি, বান্না ও দেলওয়ার মিলে হলো আমাদের Adytum Group. প্রথমে শুধুই স্ট্যাডি আর প্রেজেন্টেশনের জন্য গ্রুপটা করা হলেও আস্তে আস্তে আমরা ছয়জন অনেক ভালো বন্ধু হয়ে যাই। ভার্সিটিতে ক্লাসের পরের সময়গুলো আরও রঙিন হয়ে উঠেছিল কারণ আবিদ আমাদের সাথে ছিল। এতো মজার সব দুষ্টুমী আবিদ করতো তা আমি কোনোভাবেই ভুলতে পারি না।
আমাদের কারো মন খারাপ থাকলেই ও গান গেয়ে শুনাতো। ক্লোজআপ ওয়ানের কারনে আবিদ তখন মানুষের মাঝেও অনেক পরিচিত। আমরা কোথাও ঘুরতে গেলে প্রায়ই লোকজন এসে ওর সাথে কথা বলত, ছবি তুলত। এগুলো নিয়ে আমরা সারাক্ষণ মজা করতাম। দুষ্টুমী করে বলতাম, ‘তুই তো ইস্টার হয়ে গেছিস’। আমাদের এসব কথা শুনে ও অনেক লজ্জা পেত। কিন্তু সাধারন মানুষের কাছে ও এতো পরিচিত থাকার পরও কোনোদিন এটা নিয়ে অহংকার করতে দেখিনি।
আমাদের মার্কেটিং ১১ তম ব্যাচের করা প্রতিটি অনুষ্ঠানে আবিদের অংশগ্রহণ ছিল অবধারিত। আসলে ওকে ছাড়া আমাদের অনুষ্ঠান সম্ভব ছিল না। ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল থেকে শুরু করে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান, ব্যাচ ট্যূর সব কিছুতেই আবিদ ছিল মধ্যমনি।
আমাদের ব্যাচের কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় ও নিজের ক্যারিয়ারের কথাও চিন্তা করেনি। রাত জেগে অনুষ্ঠানের কাজ করেছে। সব কিছু ঠিক-ঠাক করেছে। যে কোন ট্যূরে রাত জেগে আমাদের গান শুনিয়েছে।
বিবিএ র্যাগ-ডে অনেক বড় করে হয়েছিল। কিন্তু কাজের চাপে সে অনুষ্ঠানে আবিদ গান গেতে পারেনি। এ নিয়ে ওর কষ্টের শেষ ছিল না। বারবার বলত, আমি গান গেতে পারলাম না, এ কষ্ট আমার সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে। তাই এমবিএ করার সময় বলে দিয়েছিল, যতই কাজ থাকুক, গান আমি র্যাগ-ডেতে গাবই।
র্যাগ-ডে এর রাতেই ওর টিভিতে একটি লাইভ অনুষ্ঠান ছিল। সারাদিনের ছুটোছুটি, এতো কাজের পর অনেক অনিচ্ছাসত্ত্বেও শুধুমাত্র দায়িত্ববোধের কারনে ক্লান্ত শরীর নিয়ে আবিদ অনুষ্ঠানে যায়। অনুষ্ঠান শেষ করে আবার রাত দুটায় আমাদের মাঝে ফিরে আসে।
এমবিএ’র র্যাগ-ডে তে ওর গাওয়া শেষ গানটি ছিল- ‘দেখা হবে বন্ধু কারনে আর অকারনে...’
আমাদের সবার প্ল্যান ছিল ১১/১১/২০১১ তে আমরা মার্কেটিং ১১তম ব্যাচের সবাই আবার একসঙ্গে হবো।
আমরা সবাই আবার একসাথে হয়েছিলাম ৩০ জুলাই। শহীদমিনারে। আর সব সময়ের মতো আবিদ এবারও আমাদের মধ্যমনি। শুধু এবার আবিদ নিথর হয়ে শুয়ে আছে। ওর মুখের চিরচেনা দুষ্টমী মাখা হাসিটুকু ছিল না। বাকি আমরা সবাই ছিলাম।
১৮ জুলাই ছিল আবিদের জন্মদিন। ওইদিন শবে বরাতের রাত ছিল। নামাজ পড়ে আবিদকে ফোন দিয়ে শুভেচ্ছা জানাই। বলল, আমার জন্য অনেক দোয়া করিস।
সেই বন্ধুটি মাত্র ১০ দিনের ব্যবধানে হারিয়ে যাবে? কে ভাবতে পেরেছিল?
বসন্তের হাওয়ার মত এসে আমাদের জীবন রাঙিয়ে দিয়ে পাগলা হাওয়ার মত সবকিছু ওলটপালট করে আবিদ চলে গেলো। ওর গাওয়া আমাদের প্রিয় রবীন্দ্রসংগীতের কথাগুলো যে এমনভাবে সত্য হয়ে যাবে কোনোদিন চিন্তাও করিনি।
‘জাগরণে তারে না দেখিতে পাই, থাকি স্বপনের আশে,
ঘুমের আড়ালে যদি ধরা দেয়, বাঁধিব স্বপনো পাশে
এতো ভালোবাসি এতো যারে চাই, মনে হয় নাতো সে যে কাছে নাই
যেন এ বাসনা ব্যাকুল আবেগে তাহারে আনিবে ডাকি। ।
দিবস রজনী আমি যেন তার আশায় আশায় থাকি। । ’
আজ এ বন্ধু দিবসে খুব মনে পড়ে আবিদকে। খুব গান শুনতে ইচ্ছে করে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৭ ঘণ্টা, আগস্ট ৭, ২০১১