আত্মশুদ্ধির এক সুন্দর ও গঠনমূলক দিকনির্দেশনা সিয়াম সাধনার মধ্যে নিহিত। সায়েম অর্থাৎ রোজাদার কোন কোন বিষয়বস্তু থেকে বিরত থাকবে? আমরা জানি, রমজান মাসে সূর্যোদয় থেকে রাত পর্যন্ত পানাহার, শারীরিক সংসর্গ ইত্যাদি থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আমরা পূর্বেও উল্লেখ করেছি, বিষয়বস্তু কখনো কলুষিত নয়, বরং সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ। নফসে আম্মারা যখন মোহাবিষ্ট হয়ে কোনো বিষয়বস্তু বা ব্যক্তিকে গ্রহণ বা ধারণ করে, অথবা তার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে যায় তখনই সে বস্তু বা ব্যক্তি তার জন্য তাগুত হয়ে যায়। তাই সিয়াম সাধনা হচ্ছে বিষয়বস্তুর প্রভাব বা মোহ মুক্ত হওয়ার এক প্রকৃষ্ট আত্মিক সাধনা। আমরা পূর্বে নফসে আম্মারা বা ষড়রিপুর কথা বলেছি। সিয়াম সাধনা হচ্ছে ষড়রিপুর প্রভাব মুক্ত হয়ে নফসে লাওয়ামা তথা অনুতাপশীল আত্মায়, অতঃপর পরিশুদ্ধ আত্মায় পরিণত হবার ঐশী সাধনা।
সিয়াম সাধনায় আত্মশুদ্ধির দর্শন বা শিক্ষা থেকে আজ আমরা অনেক দূরে। শুধু উপবাস থাকাকেই আমরা সিয়াম সাধনা মনে করে থাকি। আমাদের আলেম-ওলামা ও পীর মোশায়েখরাও আমাদের এ মহান আদর্শ ও শিক্ষা থেকে দূরে রেখেছেন। ত্যাগ ও বর্জনের এ মহান আদর্শের মধ্যে তাদেরকেও দেখা যায় না। ভোগবাদের মধ্যে আমরা আপাদমস্তক এমনভাবে ডুবে আছি যে, ত্যাগ ও বর্জনের কথা চিন্তায়ও আসে না।
যে কথা বলছিলাম, বৈধ কিছু বিষয়বস্তুর ভোগবিলাস থেকে রমজানের প্রতিটি দিনের কিছুটা সময় আমাদের বিরত থাকার নির্দেশ আল্লাহপাক কেন দিয়েছেন? ত্যাগ ও বর্জনের অনুশীলনের মাধ্যমে সমস্ত বস্তু-আকর্ষণ থেকে মুক্ত হয়ে একমাত্র রাব্বুল আলামিনের দিকে মুখাপেক্ষি হয়ে থাকার প্রশিক্ষণ সিয়াম সাধনার মধ্যে নিহিত রয়েছে।
‘আমানু’ শব্দের অর্থ যাঁরা ঈমান এনেছে। শুধু মুখে ঈমান আনা এবং আনুষ্ঠানিক ইবাদত সম্পন্নকারীকে আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে সত্যিকার ঈমানদার হিসেবে স্বীকৃতি দেননি। যারা বিশ্বাসে, চিন্তায়, চেতনায় এবং কর্মের মাধ্যমে ঈমানের কাজ সম্পন্ন করেন এবং আল্লাহ ও রাসুলের (সা.) সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য জান ও মাল উৎসর্গ করে সেবাব্রতে আত্মনিয়োগ করেন, আল্লাহর ভাষায় তারাই মুমিন। যেমন পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘ইয়া আইউহাল্লাজিনা আমানু বিল্লাহে ওয়া রাসুলিহি ওয়াল কিতাবিল্লাজি নাজ্জালা’। অর্থাৎ, হে যারা ঈমান এনেছো (বলে বলছো) তোমরা (পুনরায়) ঈমান আনো (বিশ্বাস এবং কর্মের মাধ্যমে) আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের (সা.) প্রতি এবং তিনি যে কিতাব নাজিল করেছেন তার প্রতি (অর্থাৎ তাঁর আদেশ-নিষেধ বাস্তবায়নের মাধ্যমে)। সুরা নিছা : ১৩৬
প্রিয় নবী (সা.) বলেছেন, ‘লাইছা মুমিনু মাহ মাউনা ফিল মাসজিদি ইয়াকুলুনা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসলুুল্লাহ বারছাহি ফাহুয়া মুনাফিকুন’। অর্থ : ওই সকল লোক মুমিন দলভুক্ত নয় যারা মসজিদে সমবেত হয়ে বাহ্যভাবে (মুখে, অন্তঃকরণে নয়) কালেমা পাঠ করে থাকে- যেহেতু ওই সমস্ত লোক মুনাফিক বা কপট (হাদিসে কুদসি)।
‘মান কালা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ আলফা আলফা মাররাতিহন বিলা তাহকিক ফাহুয়া কাফিরুন’। অর্থাৎ, যদি কেউ সত্যোপলব্ধি ব্যতীত হাজার বারও কালেমা পাঠ করে তবুও সে কাফের। পবিত্র কুরআনেও এরকম অনেক আয়াত বিদ্যমান যাতে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, শুধু মুখে স্বীকৃতি দিলে ও আনুষ্ঠানিকতা পালন করলেই ঈমানদার হওয়া যায় না।
‘তোমাদের ওপর সিয়াম কেতাবস্থ করা হলো’ (২:১৮৩)- এ কথার অর্থ এ নয় যে, কাগজ-কালির মাধ্যমে বই আকারে তা প্রকাশ করা হলো। ‘কেতাব’ অর্থে এখানে আমানুর দেহ এবং মনকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ তোমাদের দেহ ও মনে সিয়ামের সাধনপদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছে।
সিয়ামের এ সাধনপদ্ধতি মানবজাতির জন্য অপরিহার্য বিধায় এ ব্যবস্থা সর্বজনীন ও সর্বকালীন।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক
বাংলাদেশ সময় ২০৪০ ঘণ্টা, আগস্ট ৮, ২০১১