১৩ আগস্ট, ১৯৬১। বিভক্ত বার্লিন শহরের বিভক্তিকে দীর্ঘস্থায়ী করতেই তোলা হলো বার্লিন দেয়াল।
দেয়াল তোলার ঠিক আগের দিনে এক জংলা-জমিতে গার্ডেন পার্টির আয়োজন করে জড়ো হয়েছিলেন তৎকালীন পূর্ব জামার্নির সরকারি ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা। পার্টি চলাকালে রাষ্ট্রীয় কাউন্সিলের সভাপতি ভলটার উলব্রিখট পশ্চিম বার্লিনের সঙ্গে সীমানা বন্ধের নির্দেশে স্বাক্ষর করেন। এখানে বসেই তিনি নির্দেশ দেন বালির্নকে বিভক্ত করে দেয়াল তোলার।
এর ফলে, ১৩ আগস্ট সকাল থেকেই পূর্ব জার্মানির সেনাসদস্যরা নেমে পড়েন দেয়াল তোলার কাজে।
২০১০-এর ভরা শীতে বার্লিনে ট্যুরিস্ট বাসে বসে আমাদের নগর পরিভ্রমণকারী গাইডের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম। কিন্তু দেয়াল কোথায়? আমাদের সবার একটাই প্রশ্ন। গাইড বলে চলেন, ‘এই দিকেই দেয়াল ছিল। এখন নেই। ’
এবার আমরা গাইডের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে তাকাই জানালার বাইরে। ‘নাহ্, বাড়িঘরের দেয়াল যা-ও একটু দেখা যায় তা-ও আবার বরফে ঢাকা! বার্লিন দেয়াল না দেখে শান্তি নেই। ’
গাইড এবার বলেন, ‘ওই যে রাস্তার ওপর দাগ দেখছো ওটাই দেয়ালের ভিতের দাগ। ’ আমরা পড়িমরি হয়ে বাসের বন্ধ জানালা দিয়ে উঁকি দিতে থাকি নিচে রাস্তার দিকে। ‘উঁহু, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। একটা দাগ দেখা যায় বটে কিন্তু তা দেখে কোনও কিছু বোঝার উপায় নেই,’ মনের ভেতর অশান্তিটা থেকেই গেল।
গাড়ি চলছে শহরের নানা পথে। গাইড বলে চলছেন নগরের নানা গল্প। কিন্তু মনের ভেতর থেকে থেকে জেগে উঠছে ‘বার্লিন দেয়াল’ না দেখার দুঃখ।
ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছিল ৮ মে, ১৯৪৫। সোভিয়েত বাহিনীর কাছে জার্মানির রাজধানী বার্লিনের পতনের পর। এরপর বিজয়ী শক্তিগুলো বসেছিল বার্লিনের কাছেই পোটসডাম শহরে।
১৬ জুলাই থেকে ২ আগস্ট পর্যন্ত এক সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক জোসেফ স্তালিন, যুক্তরাজ্যের পক্ষে সে দেশের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল এবং যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সেদেশের রাষ্ট্রপতি হ্যারি এস ট্রুম্যান। তারা ঠিক করে দেন জার্মানির ভবিষৎ।
সোভিয়েত বাহিনীর দখলকৃত জার্মান-ভূমিতে ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জার্মান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক (জিডিআর)। দেশটির সরকারি নাম যাই হোক না কেন সারা দুনিয়ায় তা পূর্ব জার্মানি হিসেবেই পরিচিত হয়ে ওঠে। এক লাখ আট হাজার কিলোমিটারের একটু বেশি আয়তনের এই দেশটির ভেতরেই পড়ে যায় জার্মানির রাজধানী বার্লিন শহর। পশ্চিম জার্মানির সীমান্ত থেকে ৭০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে।
একটি দেশের রাজধানী শহরে বিভিন্ন মতের মানুষ থাকবেন এটাই স্বাভাবিক। তাই দেশটির দুই ভাগ দেখে একদল মানুষ দাবি করলেন শহরটিকেও দুটি ভাগে ভাগ করতে হবে। পূর্ব-পশ্চিম।
দেশটির বিভক্তির পর শহরটিকেও ভাগ করে দেওয়া হলো। ‘স্বাধীনতা’র সুখ পেতে পূর্ব বার্লিনের লোকেরা শুধু নন, পূর্ব ইউরোপের কমিউনিস্ট বিরোধীরা সহজেই পশ্চিম বার্লিনে এসে আশ্রয় নিতে পারতেন। তাই বার্লিনের পশ্চিম অংশ হয়ে উঠল কমিউনিস্টবিরোধী মানুষদের মক্কা।
দেয়াল তোলার আগ পর্যন্ত মাত্র এক দশকে হাজার হাজার মানুষের পশ্চিম বার্লিনের মাধ্যমে পশ্চিমা দুনিয়ায় প্রবেশের যে সুযোগ হয়েছিল, তা বন্ধ করতে পূর্ব জার্মানি সরকার শহরটির পূর্ব অংশটিকে দেয়াল দিয়ে ঘিরে ফেলার পরিকল্পনা করে।
১৩ আগস্ট সকালে উঠে বার্লিনবাসী দেখতে পেলেন রাস্তায় নির্মাণ-সামগ্রী। কাঁটাতারের স্তূপ পড়ে আছে পথের ওপর। যে রাস্তায় সোজা চলে যাওয়া যেত পশ্চিম থেকে পুবে আর পুব থেকে পশ্চিমে, এখন সেখানে বাধার প্রাচীর। বাড়ির পাশ ঘেঁষে চলে যাচ্ছে বিভেদের সেই অলঙ্ঘ্য প্রাচীর।
মজার ব্যাপার হলো, পূর্ব জার্মানির সরকার তাদের নিজেদের সীমানার ভেতরে এমনভাবে দেয়াল দিয়েছিল যাতে পশ্চিম জার্মানির সরকার এ বিষয়ে কিছু বলতে না পারে। যেন আমার বাড়ির চারপাশে আমি দেয়াল দিলে প্রতিবেশীর কী ই বা বলার থাকে!
তবে মুক্তিকামী জনতার চাপে সেই দেয়াল ভেঙ্গে পড়ে ৯ নভেম্বর, ১৯৮৯ সালে। সেই দেয়াল ভাঙ্গার বার্ষিকীতে বলা যাবে কেমন করে ভাঙ্গল এমন দেয়াল।
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় : ০০৩৫, আগস্ট ১৩, ২০১১