অনেক দিন দেখা হয় না, অফিসের গাড়ি হঠাৎ নষ্ট হওয়ায় হাতে একটু সময় পেলাম। কী মনে করে ফোন দিলাম প্রিয় অনুজ এটিএন নিউজের বিধান রিবেরুকে, একটু আড্ডা দেওয়ার ইচ্ছে নিয়ে।
প্রথমে বিশ্বাসই হচ্ছিল না! কীভাবে সম্ভব? পরক্ষণেই মনে পড়ল, তারেক ভাই বহুদিন ধরেই তার সর্বশেষ চলচ্চিত্র ‘রানওয়ে’র প্রদর্শনী এবং দেশের সিনেমা হলগুলোর সুরক্ষা নিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকা সফর করছিলেন। এ নিয়ে মাস কয় আগে তার সঙ্গে ফোনে দীর্ঘক্ষণ কথা হয়েছিল। তিনি তার এ আন্দোলনকে মিডিয়ার মাধ্যমে সহযোগিতা করার অনুরোধ করেছিলেন। অন্যদিকে, এ নিয়ে আমি তাঁকে বিস্তৃতভাবে লিখতে অনুরোধ করেছিলাম, তিনি কথা দিয়েছিলেন সময় পেলেই লিখবেন। সেই ‘সময়’ তাকে দিল না সড়ক দুর্ঘটনারূপী যমদূত। মিশুক ভাই ছিলেন তারেক ভাইয়ের সর্বশেষ ছবি ‘রানওয়ে’সহ কয়েকটি ছবির সিনেমাটোগ্রাফার। ভেবেছিলাম, তারেক ভাই-মিশুক ভাই এরকম কোনো আয়োজনেই হয়তো কোথাও যাচ্ছিলেন।
কিন্তু তারাও যে দুর্ঘটনায় পড়তে পারেন, এবং গাড়ি দুর্ঘটনায় তাদের মৃত্যু হতে পারে, এ কথাটা ভুলেও মনে আসেনি।
পরে এটিএন নিউজের অফিসের নিচে গিয়ে এবং বাংলানিউজ ও এটিএন নিউজের সংবাদ দেখে এ কথা কেবল বিশ্বাসই করতে হচ্ছে না, বারবার চোখ ভিজে উঠছে। মন কোনোভাবেই বাঁধ মানছে না।
সহকর্মী রবাব রঁসার লেখা পড়ে জানলাম, তাঁরা যাচ্ছিলেন আসলে তারেক ভাইয়ের স্বপ্নের ছবি ‘কাগজের ফুল’-এর লোকেশন দেখতে, মানিকগঞ্জে। সঙ্গে ছিলেন ক্যাথেরিন মাসুদ, শিল্পীদম্পতি ঢালী আল মামুন ও দিলারা বেগম জলি এবং আরো কয়েকজন।
এই লেখাটিও যখন লিখছি, ঘটনাটিকে কোনোভাবেই মানতে পারছি না, লেখা আসছে না, বরং চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, আমার দেশের দুই হীরের টুকরো সন্তানকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যা করেছে যানরূপী ঘাতক, কিন্তু নেপথ্যে আছে ‘দায়িত্বশীল’ সরকার এবং তার প্রশাসনযন্ত্র।
মনে পড়ছে, আশির দশকে আমরা যখন উদ্যমী কিশোর, তখন দূর মফস্বল শহর থেকে শুনতাম রাজধানীতে বিভিন্ন সৃজনশীল তরুণদের আড্ডার কথা। এ আড্ডাগুলো হতো টিএসসি-হাকিম চত্বর-মধুর ক্যান্টিন, শাহবাগের আজিজ মার্কেট ও মৌলি রেস্তোরাঁ আর বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্রে। এখানে চলত সৃষ্টিশীলতার স্বপ্ন বোনা। এখানকার আড্ডার মধ্যমণিরা পঠন-পাঠন, চলচ্চিত্র দেখা, গল্প-কবিতা লেখা, গান গাওয়া, ছবি আঁকা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড করা শুধু নয়, ভাবতেন এমন কিছু করবেন, যা আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে আনবে নতুন প্রাণ, দেবে বন্ধ্যাত্ব থেকে মুক্তি।
আজকে তাঁরাই দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন। স্বৈরশাসনে অবরুদ্ধ স্বদেশকে যাঁরা সাংস্কৃতিকভাবে মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন তাঁদের তারুণ্যের শক্তি ও সাহস দিয়ে, তাঁরাই আজ হয়ে উঠেছেন প্রায়-প্রবীণ। সেই তারুণ্যর সঙ্গে বোধ, অভিজ্ঞতা ও কর্মসাধনা দিয়ে যারা তাঁদের স্বপ্ন অব্যাহত রেখেছিলেন তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীর, ঢালী আল মামুনরা ছিলেন সেই সব স্বপ্নমুখর দলের উজ্জ্বল মুখ। তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম, আমরা যাঁরা বিভিন্ন মাধ্যমে সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছি, আমাদের প্রত্যক্ষ- পরোক্ষ প্রেরণা ছিলেন তাঁরাই। তাঁরা অনেকেই আমাদের শিক্ষকের ভূমিকাও পালন করেছেন নানাভাবে।
আজ যখন বিশ্বজনীন বোধ ও অভিজ্ঞতা দিয়ে তাঁরা পৃথিবীজুড়ে স্বদেশকে তুলে ধরছেন, দেশকে অনেক কিছু দেবার জন্য নিজেদের সংহত করছেন, তখন আমরা তাদের একে একে সজ্ঞানভাবে ‘হত্যা’ করে চলেছি।
এই মৃত্যুকে কেন ‘হত্যা’ বলছি? কারণ যে দেশে অনিয়মই নিয়ম, যে দেশের আমলা-মন্ত্রীরা মুখে বড় বড় বোলচাল ঝাড়েন, অথচ কাজের বেলায় ঠনঠন, তারা যখন দেশের মানুষের অপমৃত্যুর পর তাৎক্ষণিকভাবে শোকবার্তা পাঠিয়ে সান্ত্বনা দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, অথচ কোনো প্রতিকারই করেন না, তখন তাদেরকে কি আমরা জ্ঞানপাপী এবং হত্যাকারীর তালিকায় রাখব না? এটি কি তাদের কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ নয়? মানুষের জীবন নিয়ে কী শুরু করেছেন আপনারা, বলুন তো? একটা দেশ ক্রমাগত রসাতলে যাচ্ছে, অথচ আপনারা বক্তৃতা-বিবৃতিরূপী নিরোর বাঁশি বাজাচ্ছেন! একটুও কি ভাবছেন না, আপনাদের আপনজন যখন এভাবে নিহত হয় তখন আপনাদের কেমন লাগে?
অন্তহীন সড়ক ও নৌ দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু আর আপনাদের কাষ্ঠ-সান্ত্বনা এবং কখনো কখনো নিহতের পরিবারকে সামান্য ‘ভিক্ষাদান’-- এ তো গরু মেরে জুতোদানের চেয়েও নিকৃষ্ট কিছু।
আপনারা ঢাকা শহরের যানজট নিরসনের জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছেন, অথচ রাজধানীর বাইরের ফাঁকা রাস্তায় যখন দূরপাল্লার বাস-ট্রাক ড্রাইভাররা বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে বছরে বছরে লাখ লাখ মানুষকে পরপারে পাঠিয়ে দিচ্ছে, তাদের প্রতিকারের জন্য আপনারা কী করছেন? এই সড়কের নিরাপত্তা বিধান কি ঢাকার যানজট নিরসনের চেয়ে কঠিন? প্রতিদিন যে এভাবে সজ্ঞান-হত্যাউৎসব চলছে, কতজনকে আপনারা এর দায়ে শাস্তি দিয়েছেন, এইসব হত্যার উপযুক্ত শাস্তি দিয়েছেন?
গত তিন মাসে এই যে সড়ক-মৃত্যুর উৎসব, তারপর যদি আবার এ ধরনের ঘটনা ঘটে, তাহলে দেশের জনসংখ্যা কমানোর জন্য হয়তো পরিবার পরিকল্পনার প্রয়োজন হবে না।
এই দেশ আমাদের কয়টি তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীর, ঢালী আল মামুন দিতে পেরেছে? অথচ তারা স্বাভাবিক জীবনের আরো বিশ-পঁচিশ বছরের আয়ু থাকতেই চলে যেতে বাধ্য হলেন? তারা যদি দীর্ঘায়ু পেতেন আমাদের কত কিছুই না দিতে পারতেন! আর তাঁদের মতো সজ্জন, সাহসী, সৃজনশীল মানুষ একটি দেশে কজন জন্মান?
অবস্থা এমন যে, দেশের সড়কগুলো হয়ে উঠেছে এক-একটি মৃত্যু-ফাঁদ, বরং বলা উচিত মৃত্যু উপত্যকা। এ উপত্যকায় আরো যুক্ত হবে একের পর এক প্রাণ। সেটা হতে পারি আমি, আপনি, যে কেউ। আর এভাবেই আমাদের সড়কগুওলো হয়ে উঠবে এক-একটি দীর্ঘ মৃত্যু-সড়ক। কিন্তু তারপরও আমাদের টনক নড়বে না। কোনোদিনই না? কোনোদিনই না???
ই-মেইল : saikathabib@gmail.com
বাংলাদেশ সময় ২১১৫ ঘণ্টা, আগস্ট ১৩, ২০১১