অনেকে মনে করেন, ব্যক্তিকে হত্যা করলে তাঁর চিন্তা-চেতনা, আদর্শ, মতবাদ, বিশ্বাস এ সকল বিষয়গুলোও হয়তো হারিয়ে যাবে। বিশ্ব ইতিহাসে এ ধারণার প্রতিফলন বহুবারই আমরা দেখতে পেয়েছি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট গভীর রাতে বাঙালি জাতির নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর পরিবারসহ হত্যা করা হয়। এ হত্যা ইতিহাসকে নিন্দিত করেছে। বাংলাদেশের মানুষ এমন এক নেতাকে মেরে ফেলল যে নেতার বাংলাদেশকে জন্ম দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে কি বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনা, দর্শন সবকিছু মুছে গেছে?
আজ এতবছর পরও আমরা বঙ্গবন্ধুর কথা বলি, তাঁর চেতনার কথা বলি।
বঙ্গবন্ধু মৃত্যুকে ভয় পেতেন না। একবার ডেভিড ফ্রস্টারকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেছিলেন, ‘যে মানুষ মরতে রাজি, তাকে কেউ মারতে পারে না। আপনি একজন মানুষকে হত্যা করতে পারেন। সে তো তার দেহ। কিন্তু তার আত্মাকে কি আপনি হত্যা করতে পারবেন? না, তা কেউ পারে না। এটাই আমার বিশ্বাস। আমি একজন মুসলমান এবং একজন মুসলমান একবারই মাত্র মরে, দুবার নয়। ...’
স্বপ্নযাত্রা পাঠকদের জন্য বহু বিখ্যাত জনের ভাষণ প্রকাশ করে থাকে। ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে ১৯৭৫ সালের ১১ জানুয়ারি, সামরিক একাডেমিতে বিদায়ী ক্যাডেটদের উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণটি সংক্ষেপিত করে দেওয়া হলো।
ক্যাডেট ভাইয়েরা,
আজ তোমাদের ট্রেনিং শেষ করলে। কিন্তু তোমাদের মনে রাখতে হবে, এটা এক পর্যায়ের শেষ আর এক পর্যায়ের শুরু। পরের পর্যায়ে দায়িত্ব অনেক বেশি। আজ তোমরা ট্রেনিং সমাপ্ত করে সামরিক বাহিনীর কর্মচারী হতে চলেছ। এখন তোমাদের ওপর আসছে দেশ এবং জাতির প্রতি দায়িত্ব, জনগণের প্রতি দায়িত্ব, যে সমস্ত সৈনিকদের তোমরা আদেশ-উপদেশ দেবে, তাদের প্রতি দায়িত্ব, তোমাদের কমাণ্ডের প্রতি দায়িত্ব এবং তোমাদের নিজেদের প্রতি দায়িত্ব তোমাদের এখন দায়িত্বজ্ঞান থাকা প্রয়োজন। তা না হলে তোমরা জীবনে মানুষ হতে পারবে না। শৃঙ্খলা ছাড়া কোন জাতি বড় হতে পারেনি।
আমি অবশ্য জানি, আজ আমাদের এ একাডেমির ধরতে গেলে কিছুই নেই। আমরা সামান্য কিছু জিনিস নিয়ে এর কাজ শুরু করেছিলাম। অনেক অসুবিধার মধ্যে তোমাদের ট্রেনিং নিতে হয়েছে। সব জিনিস তোমাদের আমরা দিতে পারিনি। তোমাদের কমাণ্ডাররা অনেক অসুবিধার মধ্যে তোমাদের ট্রেনিং দিয়েছেন।
কিন্তু আজ আমি যা দেখলাম, তাতে আমি বিশ্বাস করি, পূর্ণ সুযোগ সুবিধা পেলে আমাদের ছেলেরা যে কোন দেশের যে কোন সৈনিকের সাথে মোকাবেলা করতে পারবে। তাদের সে শক্তি আছে। তবে একদিনে কিছুই হয় না। আমরা তিন বছর হল স্বাধীনতা পেয়েছি। এর মধ্যে একাডেমির জন্য যা যতটুকু দরকার, তার জন্য চেষ্টার ত্রুটি করা হয়নি। এমনকি, আমার নিজের চেষ্টায়ও এটা-ওটা জোগাড় করে এক্ষেত্রে কাজ আরম্ভ করা হয়েছে।
দুর্নীতি নির্মূল করতে হবে:
মাঝে মাঝে আমরা অমানুষ হয়ে যাই। আমরা এত রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছি। তবু অনেকের চরিত্র পরিবর্তন হয়নি। ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, চোরাকারবারী আর মুনাফেকখোর বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে। দীর্ঘ তিন বছর আমি তাদের কাছে অনুরোধ এবং আবেদন জানিয়েছি, তাদের হুমকি দিয়েছি। কিন্তু চোরা নাহি শোনে ধর্মের কাহিনী। তাই আর অনুরোধ আবেদন এবং হুমকি নয়। এবার বাংলাদেশের মানুষকে বাঁচাতে হবে। তাদের জন্য আমি আমার জীবন কারাগারে কাটিয়ে দিয়েছি। তাদের দুঃখ দেখলে পাগল হয়ে যাই। তারাও আমাকে ভালোবাসে। কালও ঢাকা থেকে আসার সময় দেখেছি, মানুষ খাবারের অভাবে কষ্ট পাচ্ছে, তাদের গায়ে কাপড় নেই। তা সত্ত্বেও হাজার হাজার মানুষ আমাকে দেখার জন্য রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি মাঝে মাঝে তাদের জিজ্ঞেস করি, তোমরা আমাকে এত ভালোবাসো কেন?
সোনার বাংলা দেখতে চাই:
আজ তোমরা কিছু বুঝতে পারবে কিনা, আমি জানি না। আমার মনে যে আজ কি আনন্দ, তোমাদের আমি তা ভাষায় প্রকাশ করে বলতে পারবো না। যখন আমি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আটক ছিলাম, যখন মিয়ানওয়ালি জেলে বন্দী ছিলাম তখন ভাবতে পারিনি যে, একদিন এখানে তোমাদের প্যারেড হবে। অবশ্য বাংলাদেশে সামরিক একাডেমি হবে, এ বিশ্বাস আমার ছিল। কিন্তু আমি দেখে যাবো, এটা আমি ভাবিনি। তবে আল্লাহ, আমাকে দেখিয়েছেন।
কিন্তু আমি আরও দেখতে চাই। আমি দেখতে চাই সোনার বাংলা। আমি দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চাই। আমি আরও দেখতে চাই, এদেশের দুঃখী মানুষ পেট ভরে খেতে পাচ্ছে। তাদের গায়ে কাপড় আছে, অত্যাচার-অবিচার বন্ধ হয়ে গেছে।
এজন্য আজ আমি তোমাদের এই প্ল্যাটফর্ম থেকে সামরিক বাহিনী, বেসামরিক বাহিনী, জনগণ-সকলের কাছে আবেদন জানাবো, সবাই সংঘবদ্ধ হয়ে- অভাব, অত্যাচার আর অনাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করো, দেশ গড়বার কাজে আত্মনিয়োগ করো। কল-কারখানায় কাজ করতে হবে, উৎপাদন বাড়াতে হবে। কাজ করবো না, কিন্তু পয়সা নেব, এমন কথা বলা আর চলবে না। তিন বছর আমি সহ্য করেছি, আর নয়। দেশের সম্পদ না বাড়লে দেশের মানুষ বাঁচতে পারে না।
আমরা রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছি। এ স্বাধীনতা নিশ্চয়ই টিকে থাকবে। একে কেউ ধ্বংস করতে পারবে না। তবে, বাংলদেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে না পারলে এ স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে। এজন্য তোমাদের কাছে আমার আবেদন রইল, তোমরা সৎ পথে থেকো। খোদা নিশ্চয়ই তোমাদের সাহায্য করবে। এই কথা বলেই আমি বিদায় নিচ্ছি।
বাংলাদেশ সময়: ১৮২৫ ঘণ্টা, আগস্ট ১৪, ২০১১