ঢাকা: বেনারসি শাড়ি নিয়ে গান, কবিতা, গল্প বাংলা সাহিত্যে সবারই জানা। নতুন বৌয়ের সাথে বেনারসির সম্পর্ক বেশ মধুর৷ একটা লাল বেনারসি শাড়ি বৌকে করে তোলে আরও সুন্দর।
তাই বেনারসির কারিগরদের এবার ঈদ আয়োজনের কোনও কমতি নেই।
ঈদ উপলক্ষে ভিড় জমেছে ঢাকার মিরপুর ১১ নম্বরে বেনারসি পল্লীতে। পছন্দমতো জমকালো শাড়ির খোঁজে ক্রেতারা আসছেন এখানে।
অন্যান্য শাড়ির তুলনায় বেনারসি শাড়ি কিছুটা বৈচিত্র্যময় হওয়ায় এটি সবার মনোযোগ সহজেই আকর্ষণ করে। কারুকাজ, রঙের ব্যবহার, ডিজাইন প্রভৃতি মিলে এক সময় বেনারসি শাড়ির চাহিদা ছিল আকাশছোঁয়া।
বিশেষ করে বেনারসি ছাড়া বিয়ের অনুষ্ঠান কল্পনাও করা যেতো না। ফলে এই শাড়ির বাজার চাঙ্গা হতে শুরু করে এবং আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে নব্বই দশকের শেষ সময় পর্যন্ত ঢাকাই বেনারসির খ্যাতি দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
গুণমানে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ায় ভারতীয় বাজারেও এর ব্যাপক চাহিদা গড়ে ওঠে। আর দেশ-বিদেশে ব্যাপক চাহিদা থাকায় বেনারসি তাঁতশিল্পে বহু লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ভারতের বেনারসের প্রায় ৩৭০টি মুসলমান তাঁতি পরিবার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসে। তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় এরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ব্যবসা শুরু করে। এদের বৃহৎ অংশটি ছিল প্রায় ২০০ পরিবারের, যারা ঢাকার মিরপুরে বসতি স্থাপন করে। তবে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে স্থানীয়রা এ পেশায় ব্যাপকভাবে জড়িত হবার পরই বেনারসি শিল্পের অগ্রগতির সূচনা ঘটে।
কাড়ির কারিগর উসমান গণি বলেন, বিদেশ থেকে আনা সুতা প্রথমে হাতে রঙ করা হয়৷ এরপর সাবান ও গরম পানিতে ধুয়ে রৌদ্রে শুকানো হয়৷ এরপর কয়েকটা সুতাকে একসঙ্গে করার জন্য পাঠায় অন্য কারখানায়৷ পরবর্তীতে সে সুতা দেয়া হয় তাঁত শ্রমিকদের, যারা গ্রাফ মাস্টারদের দেয়া ডিজাইন অনুযায়ী বেনারসি শাড়ি তৈরির কাজ শুরু করে৷ কিছুদিনের মধ্যেই তারা তৈরি করে একটা বেনারসি শাড়ি৷
বেনারসি পল্লীতে তৈরি হয় ফুলকলি কাতান, দুলহান কাতান, মিরপুরি রেশমি কাতান, মিলেনিয়াম কাতান, বেনারসি কসমস, অরগন্ডি কাতান, ব্রকেট কাতান, বেশমি কাতান, প্রিন্স কাতান, রিমঝিম কাতান, টিসু কাতান, মিরপুরি গিনি গোল্ড কাতান, জর্জেট গিনি গোল্ড কাতান, চুনরি কাতানের মতো শাড়ি ।
মিরপুর ২, ৩ ও ৫ নম্বর ওয়ার্ড এবং সেকশন ১০, ১১, ১২ ও ১৩-এর বেনারসি পল্লীর ৩০০টিরও বেশি দোকানে উপচে পড়ছে মানুষ।
মহাখালি থেকে নার্সিং বিএসসির ছাত্রী রোজি এসেছেন নিজের বিয়ের শাড়ি কিনতে। তিনি বলেন, আমার শখ বিয়েতে লাল বেনারসি পড়বো। ঈদের পর বিয়ে তাই ভিড় কম থাকাতেই কিনতে এসেছি। আর আমাদেও দেশি পণ্য ব্যবহার করা উচিত।
বেনারসি পল্লীর কারিগররা এবার ছেড়েছে জুট নেট ও জুট সিল্কের সমন্বয়ে তৈরি ৫০ আইটেমের বাহারি ডিজাইনের শাড়ি, থ্রিপিস ও টুপিস।
বেনারসির কারিগররা বলছেন, ভালোবাসা দিয়ে তৈরি তাঁদের তৈরি প্রতিটি শাড়িতেই রয়েছে আভিজাত্যের ছাপ। এসব শাড়ির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো পাকা রং আর ওজনে হাল্কা। বাজেটেও কুলোয়। তাই সমাজের উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নমধ্যবিত্ত সব শ্রেণীর তরুণী কিংবা মহিলার প্রথম পছন্দ মিরপুর বেনারসি পল্লীর শাড়ি।
জুট নেট, জুট কোটা ও নেট কাতান ঈদ স্পেশাল হিসেবে চমক সৃষ্টি করেছে মিরপুর বেনারসি পল্লীতে। অর্ডার দিয়েও অনেকে এসব শাড়ি পাচ্ছে না। ঈদ সামনে রেখে তাঁতিরা এসব পোশাক তৈরি করে দম ফেলার সময় পাচ্ছেন না।
একদিকে শো-রুমগুলোতে বিকিকিনির হিড়িক। অন্যদিকে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে উদ্যোক্তা কারিগরদের বিরামহীন প্রস্তুতি। দিনরাত ২৪ ঘণ্টা ঘুরছে তাঁতের চাকা। কমবেশি সব দোকানেই রয়েছে ঈদের বিশেষ আয়োজন।
মিরপুর ১০ ও ১১ নম্বরের বিশাল একটা অংশ জুড়ে অবস্থান করছে বেনারসি পল্লী । পুরো এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে শত শত কাতান আর বেনারসি শাড়ির দোকান। প্রায় প্রতিটি দোকানেরই রয়েছে নিজস্ব শাড়ি তৈরির কারখানা। নিজেদের দক্ষতা, ঐতিহ্যবাহী নকশা আর রুচির সমন্বয়ে তৈরি করে চলে একের পর এক কাতান- বেনারসি।
বেনারসি কুঠির মালিক আব্দুর রউফ বলেন, স্বাধীনতার পর বেনারসির ব্যবসা শুরু করে আজও চলছি। এবারের ঈদে বেনারসির নাম, ডিজাইন আর রঙের ক্ষেত্রে এসেছে পরিবর্তন, এসেছে নতুনত্বের ছোঁয়া।
তিনি বলেন, হাড্ডি সিল্ক, র-সিল্ক, কাঞ্চি ভরম, গাদে কেনা যাবে ২০০০-৩৭০০০ টাকার মধ্যে। তবে বেনারসি কাতানের মধ্যে যে শাড়ির ওজন কম, তার দাম একটু বেশি।
যাঁরা শাড়ি পরেন না, তাঁদের জন্য মিলবে সেলাই ছাড়া থ্রি-পিচ ২৪০০-৩৯০০ টাকার মধ্যে। ঈদের আগে পছন্দমাফিক ফরমায়েশ দিয়ে বানিয়ে নিতে পারেন সালোয়ার-কামিজ।
মিরপুর ১১ নম্বর বেনারসি পল্লীর এলাকার শো-রুমগুলোতে প্রবেশ করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় নানা কারণে।
মার্কেটে প্রবেশের পথটি সংকীর্ণ ,ঘিঞ্জি সরু গলি ও লোকারণ্য। এ কারণে ক্রেতারা ইচ্ছে করলেও গাড়ি নিয়ে আসতে সমস্যা হয়।
কয়েকজন বিক্রেতা অভিযোগ করেছেন, এবাওে ঈদ উপলক্ষে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে তাঁত মেলা হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত তাঁতিদের মাধ্যমে ওই মেলা আয়োজন করা হচ্ছে না।
মিরপুর ওয়ার্ড নম্বর ২, ৩ ও ৫-এর বেনারসি তাঁতি পরিবারের সভাপতি ও হানিফ সিল্কের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ হানিফ জানান, ঐতিহ্যবাহী বিশ্বখ্যাত মসলিনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে বেনারসি পল্লীতে। তাঁতের বুনন, কারচুপি না দেখলে বোঝা যাবে না বিভিন্ন ডিজাইনের কারুকার্যখচিত শাড়িগুলো কতটা দৃষ্টিনন্দন ও আকর্ষণীয়। এসব শাড়ির দামও ক্রেতার সামর্থের মধ্যেই রাখা হয়েছে ।
তিনি বলেন, এখন প্রতিদিন বেনারসি পল্লীতে প্রায় ছয় থেকে আট কোটি টাকার শাড়ি বিক্রি হচ্ছে। ২০ রোজার পর দৈনিক বিক্রি ১০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
এবার ক্রেতাসমাগম গতবারের চেয়েও ভালো বলে তিনি জানান।
বেনারসি পল্লীর হরেক নামের শাড়িগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত, জুট নেট, জুট সিল্ক, জুট কাতান, মসলিন, টিস্যু শাড়ি, কসমস সিল্ক, কাতান, জর্জেট, বেনারসি, কাতান সিল্ক, বটি কাতান, লেহেঙ্গা, বিয়ের শাড়ি ইত্যাদি। এর মধ্যে বেশির ভাগ শাড়ির দামই তিন থেকে ১৫ হাজার টাকা। তবে কাতানের সুতাকে টুইস্টিং করে বিভিন্ন আঙ্গিকে তৈরি করা জর্জেট কাতানের দাম সর্বোচ্চ লাখ টাকার কাছাকাছি।
বেনারসি পল্লীর রানা সিল্কের স্বত্বাধিকারী আশফাক আহমেদ বলেন, বেনারসি পল্লী থেকে ক্রেতারা সর্বনিম্ন ২৫শ` টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১৮ হাজার টাকার মধ্যে শাড়ি পাবেন। এছাড়াও কাতান থ্রিপিস ও টুপিচ ১২শ` টাকা থেকে ৩২শ` টাকার মধ্যে পাওয়া যাবে।
আরও জানান, এবার ঈদ ঘিরে অন্যান্য বছরের তুলনায় তাদের যথেষ্ট প্রস্তুতি রয়েছে। বিক্রিও ভাল হচ্ছে।
দোকানগুলোতে কথা বলে জানা গেছে, কাতানের দাম নির্ভর করে নকশা, উপকরণ আর জরির কাজের ওপর। এসব দোকানে সাধারণত ১৩০০-১৫০০ টাকাতেই ভালো মানের শাড়ি পাওয়া যাচ্ছে। ভালো মানের কাতান শাড়ির দাম শুরু হয় ৩০০০ থেকে। নকশা আর কাপড়ের মান অনুযায়ী এসব কাতানের দাম ১৫ হাজার পর্যন্ত হতে পারে। এসব দোকানে দরদাম করেই কেনা যাবে শাড়ি ।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, এবার উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় শাড়ির দাম একটু বেড়েছে। গুণগত মানের ভিন্নতার কারণে দামেও রয়েছে ভিন্নতা।
এ বছর কাতান পাট ছাড়া ১ হাজার ৪৫০ থেকে ৫ হাজার টাকা, মাচল্যাচ ৩ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকা, বুটি কাতান ১ হাজার ৫৫০ থেকে ৬ হাজার টাকা, অপেরা ১ হাজার ৮শ’ থেকে ৮ হাজার টাকা, ফিগা শাড়ি ২ হাজার ৫শ’ থেকে ৫ হাজার টাকা, কাতানের থ্রি-পিচ ১ হাজার ৮শ’ থেকে ৫ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এসব শাড়ি বিয়ের জন্য আলাদাভাবে তৈরি করা হয়। প্রকার ভেদে এর দামেরও পার্থক্য আছে। বিয়ের জন্য এ শাড়ি ১০ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়।
এছাড়া এখানকার শোরুমগুলোতে স্থানীয় শাড়ির পাশাপাশি ভারতীয় শাড়িও বিক্রি হচ্ছে। ভারতীয় সিংমাল শাড়ি ৩ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকা, নেট মসলিন ৪ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা, জর্জেট শাড়ি ২ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা, রেশমি ৬ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা আরও জানান, ক্রেতাদের মধ্যে বিদেশি শাড়ির চেয়ে দেশীয় বেনারসি শাড়ি কেনার আগ্রহ একটু বেশি। ভারতীয় শাড়ির চেয়ে দেশি শাড়ির গুণগত মান ভালো।
দেশীয় শাড়িগুলোতে নতুন ডিজাইনের নিপুন কারুকাজ ক্রেতাদের আকৃষ্ট করেছে।
মোহাম্মাদী সিল্ক হাউসে বিক্রেতা আব্দুর রহমান বলেন, ঈদের সময় বিয়েসহ বিভিন্ন সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান বেশি হওয়ায় শাড়ি বিক্রির পরিমাণ বেড়ে যায়। তাছাড়া অনেকেই লাভের আশায় আগেই কেনাকাটা শুরু করেছেন। এখনো বেশিরভাগ ক্রেতা বিয়ের শাড়ি কিনছেন।
পুরো পল্লিতে দেখা গেল, ক্রেতারা দামাদামি করে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন পছন্দের শাড়ি। শুধু খুচরা বিক্রেতা নয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাইকাররাও ছুটে আসছেন এখান থেকে বেনারসি সংগ্রহের জন্য। যেন দেশি পণ্য কিনে হচ্ছে ধন্য ।
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৫৩০, আগস্ট ১৬, ২০১১