পবিত্র কুরআনের আয়াত: গণনার কয়েকটি দিনের জন্য। অতঃপর তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ থাকবে ভ্রমণে থাকবে, তার পক্ষে পরবর্তী সময়ে তা পূরণ করে নিতে হবে।
মোফাচ্ছেররা উপরোক্ত আয়াতে করিমের তাফসির করতে গিয়ে নিম্নোক্ত মন্তব্য করেছেন। যেমন-- ‘গণনার কয়েকটি দিনের জন্য’ এ আয়াতের দ্বারা পবিত্র রমজান মাসকে বুঝিয়েছেন। অসুস্থ ও ভ্রমণরত ব্যক্তির জন্য পরবর্তী সময়ে রোজা পূর্ণ করে দেওয়ার নির্দেশ রয়েছে। রুগ্ন ব্যক্তি বলতে যারা শারীরিকভাবে রোজা রাখতে অক্ষম তাদের বোঝানো হয়েছে এবং ভ্রমণরত ব্যক্তির ক্ষেত্রে তারা একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব ও সময়সীমা নির্ধারণ করেছেন। কোনো কোনো শাস্ত্রবিদ তিন মঞ্জিল তথা পায়ে হেঁটে তিন দিনে যতটুকু পথ অতিক্রম করা যায়, পরে আলেমরা তা ৪৮ মাইল নির্ধারণ করেছেন।
তার পরের আয়াতাংশে আল্লাহপাক রোজা রাখতে যারা কষ্টবোধ করে তাদের জন্য ‘ফিদিয়া’ হিসেবে একজন মিসকিনকে আহারদানের অনুমতি দিয়েছেন। তাফসিরকারকদের মতে, তার পরবর্তী আয়াতে ‘ফমান শাহিদা মিনকুম শ্বাহরা ফাল ইয়াসমহু’। অর্থাৎ, তোমাদের যারা এ মাস পাবে তারা যেন রোজা পালন করে। ‘ফিদিয়া’ তাদের জন্য যারা শারীরিক ও মানসিকভাবে রোজা রাখতে অক্ষম। রোজা রাখতে সক্ষম ব্যক্তির জন্য ‘ফিদিয়া’ উক্ত আয়াতে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে।
গণনার কয়েকটি দিন বলতে ফিকহ শাস্ত্রবিদরা রমজান মাসকে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ গণনাকৃত সময়সমূহ হচ্ছে সিয়াম কাল। এ কথার মধ্যে সিয়ামের নিগূঢ় তথ্য নিহিত রয়েছে। বস্তুমোহের তেষ্টাগুলো ইন্দ্রিয়দ্বার দিয়ে অহরহ আমাদের মস্তিষ্কে প্রবেশ করেছে এবং তাগুতের আখড়ায় পরিণত হচ্ছে। এ মোহগুলোকে হিসাবমতো বর্জন বা প্রত্যাখ্যান করার পদ্ধতির নাম হচ্ছে সিয়াম সাধনা। তাই নফসের ওপর চব্বিশ ঘণ্টার তাকওয়ার এক পাহারা বসাতে হয়। অত্যন্ত সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হয় যাতে ইন্দ্রিয়পথে অসতর্ক অবস্থায় কোনো মুহূর্তে শয়তানের আজ্ঞাবহ কোনো বিষয় প্রবেশ করতে না পারে।
অসুস্থ ও ভ্রমণরত অবস্থা বলতে এখানে মানসিক অসুস্থতা ও বস্তুপ্রাপ্তির অত্যধিক মনোবাসনাকে বুঝানো হয়েছে। তাকওয়া বা আল্লাহর ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীলতা অর্জন করতে না পারলে মানুষ মানসিকভাবে অসুস্থ থাকে আর সে অবস্থায় ষড়রিপুর প্রলোভন বা প্রবঞ্চনা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা কিছুতেই সম্ভব নয়। সুতরাং কোন কোন বিষয়বস্তু তার জন্য ইহ ও পরকালের মঙ্গল বয়ে আনবে অথবা তার আত্মার ক্ষতিসাধন করবে সে সমস্ত বিষয়ে মানুষ সম্যক অবগত থাকে না। ফলে ‘ফোরকান জ্ঞান’ বা ভাল-মন্দের পৃথককরণ জ্ঞান ছাড়া সিয়াম সাধনা সফলতা অর্জনে ব্যর্থ হয়। (পবিত্র কুরআনের আর এক নাম ফোরকান)।
ফিকহ শাস্ত্রবিদরা ভ্রমণকালের যে দূরত্ব ও সময়সীমা নির্ধারণ করেছেন, তা সেকালেরই একটি ধারণা। এতে আত্মিক দর্শন অনুপস্থিত। যোগাযোগব্যবস্থা এবং সফরকালীন দুঃখকষ্টের কথা বিবেচনা করে তারা সেরকম একটি ফয়সালা দিয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপট ভিন্ন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির কারণে সে ব্যবস্থা এখন নেই। জাপানের আবিষ্কৃত দ্রুতগামী ট্রেন ঘণ্টায় ৫১২ কিমি তথা ৩২৩ মাইল অতিক্রম করতে সক্ষম। সে হিসেবে তিন মঞ্জিল বা তিন দিনে তা অতিক্রম কওে ৩৭৫১২ কিমি। সুতরাং ঐ নির্দিষ্ট তিন দিনে বসে বসে বা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পৃথিবীকে প্রায় একবার প্রদক্ষিণ করা যায় আর তাতে শারীরিক কষ্টও অনুভব হবার কথা নয়। তাছাড়া বিমান ও রকেটের গতির কথা না হয় বাদই দিলাম।
আমরা আগেই উল্লেখ করেছি পবিত্র কুরআনের বাণী সর্বকালীন ও সর্বজনীন। সুতরাং বর্তমান অবস্থায় রমজান মাসে ভ্রমণকালে আল্লাহপাক রোজা রুখছত বা ছাড় দিয়েছেন এমনটি মনে করার আর কোনো যৌক্তিকতা নেই (কসর নামাজের বেলায়ও একই যুক্তি প্রযোজ্য)। সুতরাং পবিত্র আয়াতের নিগূঢ় তত্ত্বের দিকে অগ্রসর হয়ে এর অর্থ এভাবেই বুঝে নেওয়া সমীচীন হবে বলে মনে হয় যে, প্রবৃত্তির লোভ-লালসার জগতে মানসিক ভ্রমণরত অবস্থায় সিয়াম সাধনা তার কার্যকারিতা হারাবে। সুতরাং মনোজগতে নফসানিয়তের ভ্রমণ বন্ধ করা সিয়াম সাধনার পূর্বশর্ত।
খোদাতায়ালার প্রতি তাওয়াক্কুল দৃঢ় করে তাকওয়া অবলম্বন করে প্রত্যেককে সিয়াম সাধনা করতে হবে। তবেই তা হবে মানুষের জন্য কল্যাণকর। ‘যদি তোমরা বুঝে থাকো’-- এ কথাটির মাধ্যমে আল্লাহপাক মানুষকে এ বিষয়ে তথা কল্যাণের বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করার নির্দেশ দিচ্ছেন।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক
বাংলাদেশ সময় ১৯০০ ঘণ্টা, আগস্ট ১৬, ২০১১