ঢাকা: বাঙালি নারীর চিরন্তন সৌন্দর্য যেন ফুটে ওঠে শাড়িতেই। আর মোহনীয় ডিজাইনের বাহারি শাড়ির জন্য বরাবরই বিখ্যাত রাজধানীর নাটকপাড়া বেইলি রোড।
এবারও বেইলি রোডের শাড়ি ঐতিহ্যের ব্যতিক্রম হয়নি। দেশি সুতা, তাঁতিদের ঘাম ঝরানো শ্রম আর নয়নাভিরাম নকশায় তৈরি হওয়া শাড়িতে এরই মধ্যে সেজে উঠেছে বেইলি রোড।
ঈদ এলে বাঙালি নারীদের শাড়ি ছাড়া যেন সাজগোজ অপূর্ণই থেকে যায়। পাশ্চাত্যের ছোঁয়া এলেও বাঙালি মেয়েদের পোশাক পছন্দের তালিকায় এখনও শীর্ষে শাড়ি। রাজধানীর বেইলি রোডে গেলে সে কথারই প্রমাণ মেলে।
প্রতি বছর ঈদ এলে শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশের উচ্চ, মধ্য ও নিম্নবিত্ত পরিবারের নারীরা শাড়ি কেনার জন্য ছুটে আসেন বেইলি রোডে। সব বয়সী নারীদের কাছেই এখন দেশি সুতির শাড়ি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
তাদের চাহিদার প্রতি লক্ষ্য রেখেই রাজধানীর এই অভিজাত এলাকায় গত ২৫ বছর ধরে তিলে তিলে গড়ে উঠেছে দেশি শাড়ির এই বাজার। এখান থেকে শাড়ি না কিনলে যেন ঈদের আনন্দ পূর্ণই হয় না শিক্ষিত নারীদের।
সাদা-কালো, লাল-সবুজ বাহারি রঙের রকমারি সব শাড়ি শোভা পাচ্ছে এখানকার শাড়ির দোকানগুলোতে। ক্রেতারাও আসছেন রকমারি এসব শাড়ির হাতছানিতে। দর-দাম পরখ করে দেখছেন। কিনছেনও কেউ কেউ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্রী কুমকুম শাড়ি কিনতে বেইলি রোডে এসেছেন। তিনি জানালেন, বেইলি রোড থেকে সুতি শাড়ি কেনাটা যেন এখন একটা ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। এখানে নির্দিষ্ট দামের কারণে দর নিয়ে বিক্রেতাদের সঙ্গে বিতর্কের দরকার হয় না। কাপড়ের মাপ, মান এবং রঙও ভালো।
বেইলি রোডের শাড়ি বাজারের বিভিন্ন দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রমজানের প্রথম থেকেই ঈদের কেনাকাটা শুরু হয়ে গেছে।
বেইলি শাড়ি কুটিরের ব্যবস্থাপক শাহাবুদ্দিন জানান, দেশের বিভিন্ন স্থানের বিখ্যাত শাড়ি এ বাজারে বিক্রি হয় বলেই সারা বছর ক্রেতা লেগেই থাকে। আর ঈদে তো কথাই নেই। রোজার প্রথম দিন থেকেই বাজারে বাড়তি ক্রেতা আসতে শুরু করেছেন।
দেশীয় ব্র্যান্ড ‘দেশাল’-এর স্বত্বাধিকারী সবুজ সিদ্দিকী বলেন, ‘রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে বেইলি রোডে মানুষ কেনাকাটা করতে আসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ রাজধানীর বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরাও এখানে সুলভ মূল্যের ফতুয়া, পাঞ্জাবি, থ্রি-পিস কিনতে আসেন। ’
সজনীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহেদ জামিল জানান, ক্রেতারা ঈদের জমকালো শাড়ি পরিধানের ক্ষেত্রে দেশীয় শাড়িকেই বেছে নিচ্ছেন। কথার ফাঁকে ফাঁকে তিনি একটার পর একটা দৃষ্টিনন্দন জামদানি, টাঙ্গাইল হাফ সিল্ক, মিরপুর কাতান, দেশীয় মসলিন আর পি-হ্যান্ড শাড়ির বাহার দেখালেন।
তিনি বলেন, ‘গুণে-মানে আর ডিজাইনে দেশীয় এসব শাড়ি বাইরের শাড়ির চেয়ে অনেক ভালো। দেশীয় শাড়িগুলো শুধু ঈদ নয়, যেকোনো অনুষ্ঠান, উৎসব-পার্বণে বেশ চলে। ’
বেইলি রোডের শাড়ি বাজারের প্রধান আকর্ষণ টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির। এখানে ১৮ ধরনের শাড়ি পাওয়া যায়।
এ ব্যাপারে ক্রেতাদের বক্তব্য, এখানে শাড়ির মাপ সঠিক। বিভিন্ন ধরনের দেশি শাড়ির কালেকশনও ভালো। দামও নাগালের মধ্যে।
টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরে রয়েছে দেশি-বিদেশি শাড়ির বিশাল সংগ্রহ। এসব শাড়ির দামও বিভিন্ন রকমের।
৫৫০ থেকে শুরু করে ৮৫ হাজার টাকা দামের শাড়ি পাওয়া যায় এখানে।
সবচেয়ে বেশি দাম ঢাকাই জামদানি শাড়ির। এছাড়া দেশি-বিদেশি শাড়ির মধ্যে পাওয়ার লুম চিত্তর দাম ৫৫০ থেকে ১১০০ টাকা, ব্লক প্রিন্ট ৯১০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা, টাঙ্গাইল সিল্ক প্রিন্ট ১ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা, কারচুপি ৯০০ থেকে ২ হাজার ৭০০ টাকা, বুটিক ৮০০ থেকে ৬ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
রাজধানীর মিরপুরে তৈরি সিল্ক শাড়ি বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ২০০ থেকে ১২ হাজার ৫০০ টাকায়। আর অপেরা কাতান ৭ হাজার ৫০০ থেকে ১২ হাজার ৫০০ টাকায় এবং ঢাকাই জামদানি বিক্রি হচ্ছে ৪ হাজার থেকে ৮৫ হাজার টাকায়।
বালুচরি ১ হাজার ৫০ থেকে ১ হাজার ৮০০, মার্সলেস কটন ১ হাজার ৬০০ থেকে ৩ হাজার ৫০০, টুপার্ট ১ হাজার ৭০০ থেকে ২ হাজার, এমব্র্রয়ডারি ১ হাজার ৭০০ থেকে ২ হাজার ২০০, টাঙ্গাইল জামদানি ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ৬০০ এবং সিল্ক ১ হাজার ৬০০ থেকে ৮ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
মসলিন সিল্ক ৩ হাজার ৬০০ থেকে ১২ হাজার ৫০০, হাফ সিল্ক ৮৫০ থেকে ২ হাজার ২০০, এন্ডি সিল্ক ১০ হাজার ৫০০ এবং এন্ডি কটন ৩ হাজার ২০০ থেকে ৩ হাজার ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বেইলি রোডে শাড়ির দোকান ছাড়াও বেশ কিছু দেশীয় ফ্যাশন হাউস যেমন চরকা, সাদা কালো, রঙ, অন্যমেলা, কে-ক্রাফ্ট, সজনী, উনিশ কুড়ি, রুমঝুম, জেসমিন, উৎসব, এম ক্রাফট, বেইলি শাড়ি কুটির, অনন্যা, ঝলক, রুমনি, স্মৃতি শাড়ি কুটির, বধূয়া, বুনন, এড্রয়েট, প্রভৃতি রয়েছে।
এসব ফ্যাশন হাউসেও বৈচিত্র্যময় দেশীয় শাড়ি পাওয়া যাচ্ছে।
এছাড়া এখানে পরিবারের সবার জন্য ঈদের পোশাক কেনাকাটার সুযোগ আছে।
বিভিন্ন দোকানে পাঞ্জাবি, ফতুয়া, থ্রি-পিসসহ বিভিন্ন পোশাকের বড় সংগ্রহ রয়েছে এখানে।
এসব পোশাকের মধ্যে পাঞ্জাবি ৪৫০ থেকে ৬০০ টাকা, ফতুয়া ২৮০ থেকে ৪৫০ টাকা এবং থ্রি-পিস ৮৫০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বুটিকস শাড়ির জন্য পরিচিত এম ক্রাফটের ব্যবস্থাপক মো. ইউসুফ জানান, বিক্রিও বেশ ভালোভাবে শুরু হয়েছে। কয়েক দিন পরই বাজার পুরোপুরি জমে উঠবে।
একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা রোকেয়া বেগম ৪১ হাজার টাকা দিয়ে ঢাকাই জামদানি কিনেছেন। তিনি বললেন, কয়েক বছর ধরেই এখান থেকে দেশি শাড়ি কিনে থাকি। এবার তাই বেশ আগেই এখানে শাড়ি কিনতে এসেছি।
তার মতো আরও অনেক অভিজাত ধনাঢ্য পরিবারের মেয়েরা যেমন এখানে এসেছেন শাড়ি কিনতে, পাশাপাশি নিম্ন ও মধ্যবিত্তের মেয়েদের আনাগোনাও কম দেখা গেল না। সবার চোখেমুখেই পছন্দের একটি শাড়ির কেনার তাড়া।
এখানকার ব্যবসায়ীরা জানালেন, ঈদের আগ পর্যন্ত উচ্চবিত্ত আর মধ্যবিত্ত অধিকাংশ পরিবারের সদস্যরা আতœীয়স্বজনদের উপহার হিসেবে ৪০০-৫০০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকা মূল্যের প্রচুর টাঙ্গাইল সুতি শাড়ি কেনেন।
একই সঙ্গে ঈদের দিন সকালে পরার জন্য উচ্চ, মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে নিম্নবিত্তের অনেকেই তাঁতের সুতি শাড়ি কেনেন।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাঁতের কারুকার্য, ভরাট আঁচল ও পুরো জমিনে কারুকার্য করা রংবেরঙের টাঙ্গাইল হাফ ও সিল্ক শাড়ি ২ হাজার থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে।
এ ছাড়া ৫০০ থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকা মূল্যের টাঙ্গাইল সুতি শাড়িতেও আছে নানা ধরনের ডিজাইন। চাকচিক্যময় ডিজাইনের পাশাপাশি এগুলোতে রয়েছে হরেক রকমের স্টাইল।
প্রসিদ্ধ রাজশাহী সিল্কের বেশ চাহিদা আছে। ৮০০ থেকে ৫ হাজার টাকা মূল্যের মন মাতানো রাজশাহী সিল্কও কিনছেন অনেকে।
এ ছাড়া টাঙ্গাইল তাঁতের শাড়ি ৪০০-১৫০০, টাঙ্গাইল সুতি জামদানি ২০০০-২৫০০, টাঙ্গাইল কাতান ২৮০০-৫০০০। মসলিন জামদানি ২৫০০-৪০০০, রাজশাহী সিল্ক ১২০০-৪০০০, হাফ সিল্ক ৬০০-৫০০০, মিরপুরের কাতান ২৫০০ -৩০,০০০, ঢাকাই জামদানি ২৫০০-৪০,০০০, ব্লক প্রিন্ট ৬০০-১০০০, হ্যান্ড পেইন্ট ৭০০-২০০০, হ্যান্ড স্টিচ ৯০০-৩৫০০, পাবনা কটন ৭০০-৪০০০, ভেজিটেবল ডাই ১০০০-৫০০০ টাকার মধ্যেই পাওয়া যাচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪৯ ঘণ্টা, আগস্ট ২০, ২০১১