ঢাকা, রবিবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৮ মে ২০২৫, ২০ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

দোলনা তৈরির গ্রাম

আশরাফুল ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭:৪২, আগস্ট ২০, ২০১১
দোলনা তৈরির গ্রাম

গাজীপুর জেলার কালিগঞ্জের নাগরি ইউনিয়নের নিভৃত গ্রাম বীরতুল। গ্রামটির পশ্চিমে প্রবাহিত বালু নদী, অন্যদিকে শাপলাবিল।

বীরতুলের পাশের গ্রাম পানজোরা। খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের তীর্থ পানজোরা তাদের সাধু আন্তনির স্মৃতিবিজড়িত স্থান। এখানে কিছুদিন অবস্থান করেছেন বাংলা ভাষাতত্ত্বের তিন অমর সূচনাকারীদের একজন পাদ্রি মানোএল দা আস্সুম্পসাউ। ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে তৎকালীন ভাওয়াল, আজকের গাজীপুর জেলার কালিগঞ্জে এই পর্তুগিজ ধর্মযাজক ১৭৩৪ সালে রচনা করেন বাংলা ভাষার প্রথম শব্দকোষ ও খণ্ডিত ব্যাকরণ। তাঁর বইটি ‘ভোকাবুলারিও এম ইদিওমা বেনগল্লা, ই পর্তুগিজ : দিভিদিদো এম দুয়াস পার্তেস’ নামে লিসবন থেকে বেরোয় ১৭৪৩ সালে-- এমন তথ্য রয়েছে ড. হুমায়ুন আজাদ সম্পাদিত বাঙলা ভাষা-প্রথম খণ্ড গ্রন্থে।

এসব ঐতিহাসিক গুরুত্বের সঙ্গে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এলাকাটিকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। তবে পানজোরার পাশের গ্রাম বীরতুলের নারীদের তৈরি দোলনা এ অঞ্চলের পরিচিতি তুলে ধরছে নতুনভাবে। এখানকার তৈরি দোলনা দেশের অভিজাত শ্রেণীর ঘরে আদরণীয় সামগ্রী হিসেবে গণ্য হচ্ছে। নামীদামি মার্কেটগুলোতে শোভা পাচ্ছে বীরতুলের দোলনা।

অপরূপ বুনন কৌশল আর বাহারি কারুকাজের কারণে কোনো কোনো উদ্যোক্তা বিদেশেও পাঠাচ্ছেন এই দোলনা। এসব কারণে ব্যাপক চাহিদা ও সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে এই দোলনাকে ঘিরে।

বর্তমানে বীরতুল গ্রামের সরকারপাড়া, ভুঁইয়াপাড়া, মোল্লাপাড়া ও হিন্দুপাড়া মিলে প্রায় শতাধিক দোলনার কারিগর রয়েছেন, যাদের সিংহভাগই নারী। সংসারের আর্থিক সমৃদ্ধিতে সহায়ক হওয়ায় উৎসাহ নিয়ে এ কাজে পুরুষরাও সহযোগিতা দিচ্ছেন আর অবসর সময়ে দোলনা তৈরিতে অংশ নিচ্ছে এসব পরিবারের স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলে-মেয়েরাও।

সম্প্রতি বীরতুল গ্রাম ঘুরে চোখে পড়ে নারীদের নিবিষ্ট মনে দোলনা তৈরির দৃশ্য। গাজীপুরের ঢাকা বাইপাস রোডের কালীগঞ্জ অংশের উলুখলা বাজার থেকে বীরতুল গ্রামের দূরত্ব আধ কিলোমিটারেরও কম। মূলত কৃষিপ্রধান এলাকা হলেও সাম্প্রতিক সময়ে দোলনার সাফল্য ও সম্ভাবনার কারণে অনেকেই এর দিকে ঝুঁকছেন।

বছর দশেক আগে বীরতুল গ্রামে প্রথম দোলনা তৈরি শুরু করেন ওই গ্রামের কারিমা আক্তার। তার তৈরি দোলনার ব্যাপক চাহিদা দেখা দেওয়ায় একে একে গ্রামের অন্যরাও মনযোগী হন এই কাজে।

বীরতুল গ্রামের আইয়ুব হোসেনের স্ত্রী লতিফা আক্তারের সাথে কথা বলে জানা গেল এর  সাফল্যগাথা। চাক দোলনা, চেয়ার দোলনা ইত্যাদি নানা নামের ও আকৃতির দোলনা বানান এখানকার কারিগররা। ২০০ থেকে ৩৫০ টাকা দামে বিক্রি হয় প্রতিটি দোলনা। আদরের শিশুর জন্য পছন্দ হলে কেউ কেউ আবার দামের ধার ধারেন না, বেশি দামেও কিনে নেন। নরসিংদীর বাবুবাজার ছাড়াও দেশের বড় কাপড়-সুতার বাজার থেকে লাল-নীল-সবুজ-হলুদ নানা রঙের সুতা কিনে বীরতুলের কারিগররা বানান এই বাহারি দোলনা। এক থেকে দেড় কেজি সুতায় তৈরি হয় ছোট-বড় আকৃতির একটি দোলনা।

বর্তমান বাজারে এক কেজি সুতার দাম পড়ে দেড়শ টাকা। গুণগত মান ভালো হওয়ায় রাজধানী ঢাকার অভিজাত মার্কেটের দোকানিরা আগাম দাম দিয়ে তৈরি করিয়ে নেন প্রচুর দোলনা। পাইকারি ক্রেতাদের মধ্যে মিরপুর, ধামরাই, সাভারের ক্রেতারাই বেশি।

বীরতুল গ্রামেই দেখা হলো স্থানীয় নাগরি সেন্ট নিকোলাস হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র রিয়াদুল ইসলাম রাজুর সাথে। স্কুল শেষ করে সবে বাড়ি ফিরছিল সে। জানাল, সে-ও পড়াশুনার পাশাপাশি যুক্ত রয়েছে মা-বাবার সাথে দোলনা তৈরির কাজে। দোলনার সুতা বুনতে বেশ আনন্দ বলে জানাল রাজু।

বীরতুলের নারীরা জানান, বর্তমানে সুতার দাম বেড়ে যাওয়ায় দোলনা তৈরিতে আগের মতো লাভবান নন তারা। তাই সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বীরতুলের দোলনার প্রসারের প্রচুর সম্ভাবনা বলে মনে করেন তারা।

বাংলাদেশ সময় ১৭২২ ঘণ্টা, আগস্ট ২০, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।