নারায়ণান কৃষ্ণাণ। সুইজারল্যান্ডের ফাইভ স্টার হোটেলের বাবুর্চির কাজ করে যিনি বিখ্যাত হয়েছেন।
এ মুহূর্তে তিনি ভারতের মাদুরাই শহরে ক্ষুধার্ত মানুষকে একেবারে বিনামূল্যে খাবার খাওয়াচ্ছেন। এ সেবা তাকে এনে দিয়েছে ‘সিএনএন হিরো২০১০’ খেতাব।
সিএনএন প্রতিবছর সারা বিশ্ব থেকে নানা উদ্যোক্তাদের মধ্য থেকে হিরো নির্বাচিত করে থাকে। যার স্লোগান হচ্ছে, ‘প্রতিটি মানুষই পৃথিবীটাকে বদলে দিতে পারে’।
এবার আসা যাক নারায়ণনের গল্পে। ২০০২ সালে তিনি স্বদেশ ভারত ঘুরতে আসেন। এসে দেখলেন, একটি ওভারব্রিজের নিচে এক বৃদ্ধ কুড়িয়ে খাবার খাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে নারায়ণন বলেন, যখন আমি দেখলাম ফেলে দেওয়া খাবার বুড়ো একটা মানুষ খাচ্ছে, তখন আমি কোনোভাবেই তা মানতে পারছিলাম না। আমাদের দেশে মানুষ খাবার খেতে পারবে না এটা কেমন কথা!
আমি তখন ওই বৃদ্ধকে খাবার কিনে দিই। সিদ্ধান্ত নেই আমি দেশে ফিরে ক্ষুধার্ত মানুষের পাশে এসে দাঁড়াবো।
এরপর ২০০২ সালেই নারায়ণন দেশে ফিরে আসেন। ২০০৩ সালে গড়ে তুললেন অক্ষয় ট্রাস্ট নামে সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান। তার বয়স এখন মাত্র ২৯ বছর। এ পর্যন্ত তিনি ভারতের গৃহহীন, পঙ্গু এবং মানসিক অসুস্থদের মধ্যে ১২ লাখ খাবার বিতরণ করেছেন। এ জন্য ২০১০ সালে সিএনএন হিরোর খেতাব পেয়েছেন তিনি।
নারায়ণনের দিনের শুরু ভোর চারটায়। তিনি এবং তার সহকর্মীরা ভোর থেকেই খাবার রান্নায় ব্যস্ত হয়ে যান। এরপর রান্নার পরই সকাল থেকেই গাড়িতে করে ১২৫ মাইল এলাকাজুড়ে গৃহহীন মানুষের মধ্যে খাবার বিতরণ করেন। দিনে প্রায় ৪০০ জন মানুষকে তিনি বিনামূল্যে খাবার দিয়ে থাকেন।
তিনি বেশিরভাগ সময় ব্রিজের নিচে কিংবা বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয় ক্ষুধার্ত মানুষ খুঁজে বের করে খাবার বিলি করেন।
শুধু খাওয়া নয়, কৃষ্ণাণ মানুষের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য সঙ্গে চুল কাটার সমস্ত যন্ত্র নিয়েও ঘুরে থাকেন। পঙ্গু, মানসিক অসুস্থ মানুষগুলোর জন্য তার হৃদয়ে অসীম স্নেহ। তিনি তাদের খাবার দেওয়ার সঙ্গে তাদের চুল কাটা, শেভ করাসহ দৈহিক পরিচ্ছন্নতার সেবাও দিয়ে থাকেন।
নারায়ণন কৃষ্ণাণকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, `আপনি কী আনন্দ পান এ ধরনের সেবা দিয়ে?` নারায়ণন উত্তরে বলেন, ‘আমি জানি না। তবে আমার আত্মা অনেক শান্তি পায়। যে খাবার আমি রান্না করি, সেগুলো ক্ষুধার্ত মানুষদের মাঝে বিতরণ করে মনে হয় পৃথিবীর সমস্ত সুখ এখানেই। ’
আর্থিক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখন প্রতিদিন ৩২৭ ডলার ব্যয় হয়। অনেকেই সহযোগিতা করে বলে ২২ দিনের খাবারের খরচটা উঠে আসে। আর বাকিটা দাদার ঘরের ভাড়া থেকে পুষিয়ে নিচ্ছি। ’
শিক্ষিত নারায়ণন প্রবাসে বিলাসী জীবন ছেড়ে দেশে ফিরে মানুষের সেবায় দিন কাটাচ্ছেন। তার নিজের তৈরি কোনো ঘর নেই। তিনি তার অন্যসব সহকর্মীর সঙ্গে মাটিতেই ঘুমান। দেশে ফিরে আসার পর তার বাবা-মা তার সঙ্গে কোনো সম্পকই রাখেননি।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা খুব স্বাভাবিক। তারা আমাকে এতো কষ্ট করে পড়াশোনা করিয়েছেন। ভালো ভবিষ্যতের জন্য বিদেশ পাঠিয়েছেন। কিন্তু আমি দেশে এসে এ ধরনের কাজ করি। এটা আমার পরিবার মানতে পারছিল না।
তবে আমি আমার মাকে বহুবার বলেছি, মা একবার এসে শুধু দেখে যাও আমি কি করছি। একবার আসো শুধু। তুমি এলেই বুঝবে আমি কত বড় একটা কাজ করছি। বহুদিন পর একদিন আমার মা সত্যিই এসে দেখল।
সেদিন আমার মা কেঁদে বলল, তুমি যতদিন এ কাজ করবে ততদিন আমার বাসায় তোমার জন্য খাবার তৈরি থাকবে। যেদিন এ মহান কাজটা তুমি বন্ধ করে দেবে সেদিন থেকে তোমার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক থাকবে না।
নারায়ণন আরও বলেন, আমি জানতাম আমার মা কাজটা দেখার পর আমাকে জড়িয়ে ধরবেন। হলোও তাই। এখন আমার পুরো পরিবার গৃহহীন মানুয়ের পাশে দাঁড়াই।
এ উদ্যোগের ব্যপারে তিনি বলেন, কোনো মানুষ খাবার না পেয়ে মারা যাবে, এটা তো হতে পারে না। খাদ্য মানুষের শারীরিক শক্তি জোগায়। আর ভালোবাসা মানুষকে মানসিক শান্তি দেয়। তাই মানুষের জন্য খাদ্য এবং ভালোবাসা দুটোই জরুরি।
তার জীবনের লক্ষ্য কি? এ প্রশ্নের জবাবে নারায়ণন বলেন, `মানুষকে বাঁচাতে চাই। তা যেভাবেই হোক। এটাই এখন আমার জীবনের লক্ষ্য। `
বাংলাদেশ সময় ১৬১০ ঘণ্টা, আগস্ট ২৭, ২০১১