বিশ্বের প্রায় ১৫০ কোটি মুসলমানের হৃদয়জুড়ে প্রতি বছর ঈদ আসে। ঈদের আনন্দ অনুভব করে মুসলিম সমাজের প্রতিটি সদস্য।
সারা বিশ্বের মুসলমান এক আল্লাহতে বিশ্বাসী, আল কোরআনের তারা অনুসারী, হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর তারা অনুগামী। এক আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাঁর পুরস্কারের তারা আকাক্সক্ষী। তারা সবাই আল্লাহর শাস্তি থেকে আত্মরক্ষায় সচেষ্ট।
বিশ্বেও অধিকাংশ মুসলমান রমজান মাসে রোজা রাখে। রোজার শেষেই আসে ঈদ। বিশ্বের সব মুসলমান ঈদের আনন্দে শরিক হয়। আর সে ঈদ ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়। মুসলমানদের ঈদ মূলত বিশ্ব ঈদ। অর্থাৎ ঈদের দিনটি বিশ্বজনীন খুশি ও আনন্দের দিন। পৃথিবীর সব জাতিরই আনন্দ-উৎসবের দিন আছে। কিন্তু মুসলমানের ঈদ আনন্দ-উৎসবের চেয়ে ভিন্ন ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের। ঈদের এ স্বাতন্ত্র্য অন্তর এবং অঙ্গ উভয় দিকেরই। এ স্বাতন্ত্র্যের কারণে ইসলামের ঈদ শুধু খুশি আর আনন্দই বিলায় না, বরং সেই সঙ্গে মানবতাবোধ এবং মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলিও বিতরণ করে।
ঈদের বয়স ১৪০০ বছর। মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় এসে রাসুলে করিম (সা.) দেখতে পান এখানকার লোকেরা বছরে দুটি উৎসব পালন করে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করেন, তোমাদের এ দুটি দিন কী রকম? তারা বলল, সেই জাহেলি আমল থেকে আমাদের মধ্যে এ দুটি দিন পালনের ধারা চলে আসছে। আমরা এ দু দিন খেল-তামাশা করে কাটাই। অতঃপর আল্লাহর রাসুল (সা.) তাদের বললেন, ‘শোনো, আল্লাহ জাহেলি যুগের সেই দুটি দিনের চেয়ে উত্তম দুটি দিন তোমাদের উপহার দিয়েছেন-- একটি ঈদুল ফিতর আর অপরটি ঈদুল আজহা। এখন থেকে খুশি ও আনন্দের দিন হিসেবে এ দুটি দিন উদযাপন করো। ’ সেই থেকে বিগত ১৪০০ বছর ধরে মুসলিম উম্মাহ দুই ঈদ পালন করে আসছে। রাসুলের যুগে রাসুল (সা.) ঈদের সূচনা করতেন দুই রাকাত নামাজ আদায় এবং একটি ভাষণদানের মাধ্যমে। তিনি ঈদগাহে যেতেন এক পথে আর ফিরে আসতেন অন্য পথে। পথিমধ্যে উচ্চস্বরে তাকবির পড়তেন। সালাম কালাম এবং মুসাফা ও কোলাকুলি করতেন। দরিদ্রের খোঁজখবর নিতেন। দান-সদকা করতেন। সবাইকে ঈদের আনন্দে শরিক করতেন। এভাবে রাসুল (সা.) এবং সাহাবারা আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের মাধ্যমে ঈদের সূচনা করতেন। তারপর মানুষের কল্যাণে ও সেবা করার মাধ্যমে খুশি ও আনন্দ ছড়িয়ে দিতেন ঘরে ঘরে, প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে।
বাংলাদেশ দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ। এখানে ঈদ আসে মহা সমারোহে। ঈদ উদযাপনের জন্য এখানে প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় মাসখানেক আগে থেকেই। আবার ঈদ চলে যাওয়ার পরও এর আমেজ থাকে প্রায় সপ্তাহখানেক ধরে। আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে এখন ঈদুল ফিতর। রাসুলে করিম (সা.) এই ঈদকে সর্বজনীন করার জন্য এক অনুপম ব্যবস্থা দিয়ে গেছেন। সমাজে যারা দরিদ্র, অর্থের অভাবে ঈদের খুশিতে শরিক হতে পারেন না, তারা যেন ঈদের খুশিতে শরিক হতে পারেন সেজন্য রাসুলে করিম (সা.) বিত্তবানদের ওপর একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ খাদ্যসামগ্রী বা তার মূল্য দরিদ্র মুসলমানদের দান করার নির্দেশ দিয়েছেন। তা যেন ঈদ শুরু হওয়ার আগেই দেওয়া হয়, সে নির্দেশও দিয়েছেন। এই দিনটির নাম সদকাতুল ফিতর বা ঈদুল ফিতর উপলক্ষে দান। ঈদ উপলক্ষে সর্বজনীন মেহমানদারির রেওয়াজও প্রচলন করা হয়েছে। আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব এবং যে কোনো মুসলমান যে কোনো মুসলমানের বাড়িতে মেহমান হতে পারে। মেহমানদারি করা এবং মেহমান হওয়া ঈদের অনিবার্য অংশ। সামর্থ্যবান ব্যক্তিরা আগে থেকেই মেহমানদারি করার প্রস্তুতি নেন। এমনকি দরিদ্র মুসলমানরাও ঈদের দিন কিছু না কিছু মেহমানদারি করার প্রস্তুতি নেন। প্রত্যেকেই নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী মেহমানদারি করেন। আমন্ত্রণ, আপ্যায়ন ও মেহমানদারির এই ধারাবাহিকতা ঈদের পরও কয়েক দিন চলতে থাকে। ঈদুল ফিতরে ঈদের নামাজ পড়ার পরই শুরু হয় বেড়াবার এবং মেহমানদারি করার পালা। ঈদের দিন বাংলাদেশের রাস্তা-ঘাট, ঘর-বাড়ি ঈদময় হয়ে ওঠে। সবাই নতুন নতুন জামা কাপড় পরে দলে দলে যাওয়া আসা করে। ফলে ঈদের দিন সৃষ্টি হয় এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। ঈদগাহে, রাস্তাঘাটে, ঘরে ঘরে, বাড়িতে বাড়িতে অবতারণা ঘটে আরেকটি মন মাতানো দৃশ্যের। সেটি হলো সালাম আদান প্রদানের, হাতে হাত মিলানোর, বুকে বুক মিলানোর দৃশ্য। যেন এ সমাজের প্রত্যেকে আপনজন।
আসলে ঈদ মুসলিম উম্মাহর এক অনন্য সংস্কৃতি। ঈদ মুসলিম সমাজে বয়ে আনে ঐক্য ও একতার বারতা। ঈদ মুসলিম সমাজকে উদ্ধুদ্ধ করে ভ্রাতৃত্ববোধে, সহমর্মিতায়। ঈদ মিলনের ও আপনত্বের বার্তা বয়ে আনে। দূর করে দেয় জীবনের সব গ্লানি, হƒদয়ের সব কালিমা। ঈদের দিন খোলা হƒদয়, মিষ্টি হাসি আর ঐক্য ও একতার এই অনুপম আবেশ বর্তমান ঘুণেধরা মুসলিম সমাজকে গড়ে তুলতে পারে উন্নত ও শ্রেষ্ঠতম জাতি হিসেবে। তাই আমাদের ঈদের শিক্ষা গ্রহণে এগিয়ে আসতে হবে। মাসব্যাপী একজন মুসলমান যে সততা, সত্যনিষ্ঠা ও আল্লাহভীতির পরিচয় দিয়েছেন, সারা বছর সেটাই তার জীবনাদর্শ হওয়া উচিত। আত্মসংযম, সততা, সত্যনিষ্ঠা, আল্লাহভীতি ও আনুগত্য, নিয়মানুবর্তিতা ও সময়ানুবর্তিতার যে মাসব্যাপী অনুশীলন ও প্রশিক্ষণ, ঈদুল ফিতর যেন এর সমাপনী উৎসব। এই এক মাসের প্রশিক্ষণের ভিত্তিতে যদি বাকি ১১ মাস দক্ষতার সঙ্গে জীবনের সব কাজ পরিচালনা করা হয়, তবেই মুসলিম জাতি হিসেবে আমরা ফিরে পেতে পারি আমাদের সেই হারানো গৌরব।
লেখক : সংগঠক ও প্রতিষ্ঠাতা, গাউছিয়া ইসলামিক মিশন, কুমিল্লা
বাংলাদেশ সময় ১৪৫৫ ঘণ্টা, আগস্ট ৩০, ২০১১