আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়দের বলে রাখা হয়, ‘বল সবসময় অবশ্যই মেসিকে দিবে’। আর্জেন্টাইন দলের অন্য সদস্যরা কোচের এ আদেশ মেনে চলেন।
বিশ্ব দাপিয়ে বেড়ানো এই ফুটবল তারকা মেসি বাংলাদেশে পা রাখবেন। সেই জ্বরেই ভুগছে বাংলাদেশ। মেসিকে এক নজর দেখার জন্য ফুটবল ভক্তরা অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছেন ।
একটি বিষয়ে তার ভক্তরা কি জানেন? এই তারকা ফুটবলার জীবনের শুরুতে বিক্রি হয়ে গিয়েছিলেন! বিশ্বাস হচ্ছে না?
সত্যিই! মেসির বাবা হোরাসিও মেসি তাকে বিক্রি করে দেয় স্পেনের ক্লাব বার্সিলোনার কাছে।
গল্পটা শোনা যাক। মেসি তখন আর্জেন্টিনার একটি ক্লাবের হয়ে খেলছেন। বয়স যখন ১১ বছর তখন হঠাৎ আক্রান্ত হন হরমন জনিত সমস্যায়। উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন প্রচুর অর্থ। ওই সময়ে স্পেনের ক্লাব বার্সিলোনা এগিয়ে আসে চিকিৎসার সব খরচ দেওয়ার জন্য। কিন্তু শর্ত হিসেবে বলা হয়, মেসি খেলবে বার্সিলোনাতে। হয়ে গেলো কেল্লা ফতে! বাবা বিক্রি করে দিলো পুত্রকে। তবে এ বিক্রি তো আর পিতার কোন লাভের জন্য নয়; এটা ছিল পুত্রের সুস্থতার জন্যই।
উন্নত চিকিৎসার পর মেসি ধীরে ধীরে বিশ্বের ফুটবলকে নিয়ে যান শৈল্পিক ধারায়। ম্যারাডোনা ফুটবল জগতের শৈল্পিক নাম। যিনি পায়ের কারিশ্মা দিয়ে জয় করেছে ফুটবল ভক্তদের মন। তবে ম্যারাডোনাকে তিনি কি পেছনে ফেলতে পেরেছেন? এক্ষেত্রে ম্যারাডোনার ভক্তরা নিশ্চয়ই বলবেন, ‘নাহ। ম্যারাডোনাকে পেছনে ফেলতে পারেন একমাত্র ম্যারাডোনাই। মেসিকে বরং নতুন ম্যারাডোনা বলা যেতে পারে। এর বেশি নয়। ’
আরেক বিশ্বজয়ী খেলোয়াড় ডেভিড বেকহাম জুলাইয়ের দিকে ইএসপিএনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, মেসি হচ্ছেন পৃথিবী সেরা। সে এমন একজন খেলোয়াড়; যাকে দেখে প্রতিটি বাচ্চা ছেলে ওর মতো হতে চাইবে। মেসির সব স্টাইলগুলো তারা ফলো করতে চাইবে। সে শুধু খেলোয়াড় নয়; সে হচ্ছে পৃথিবীর সেরা মানুষ। মেসি যে পরিমাণ পরিশ্রম করে তা আমাদের পক্ষেও করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। ও শুধু খেলে না; খেলাটাকে উপভোগও করে। মেসি সত্যিই এক ভিন্ন ধরনের খেলোয়াড়।
মেসির জন্ম ১৯৮৭ সালের ২৪ জুন। জন্মের ঠিক আগের বছর আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ ঘরে এনেছে। সে সময় ম্যারাডোনা জ্বরে ভুগছে গোট বিশ্ব। ম্যারাডোনা কি জানতেন তার একবছর পর এক শিশু পৃথিবীতে আসবে যে কিনা দখল করে নিতে পারে তার স্থান?
মেসি খুব অল্প বয়সে তারকা বনে গেছেন। তবে বিশ্বকাপে অভিষেক হয় ২০০৬ সালে জার্মান বিশ্বকাপের মধ্য দিয়ে। এরপরের গল্পগুলো সবার জানা।
‘স্বপ্নযাত্রা’ সফল মানুষগুলোকে নিয়ে কথা বলে থাকে। উদ্দেশ্য হচ্ছে সফল ব্যক্তিদের গল্প তুলে ধরে তরুণদের উৎসাহিত করা। আমাদের দেশের তরুণ সমাজ এসব গল্প শুনে নিজেকে বদলে ফেলার চেষ্টা করবে। এটাই স্বপ্নযাত্রা স্বপ্ন দেখে।
মেসি তেমনই এক সফল ব্যক্তিত্ব। ফুটবলকে তিনি দিয়েছেন এক শৈল্পিক রূপ।
গতবছর মেসি কাতার গিয়েছিলেন। তখন আর্জেন্টাইন ‘ক্ল্যারিন’ পত্রিকা তার একটি এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকার নেয়। যেখানে মেসি কথা বলেছেন তার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও ভাবনা নিয়ে। খুব ছোট সাক্ষাৎকার হলেও স্বপ্নযাত্রার পাঠকদের অন্যরকম স্বাদ দিবে বলে আশা করি।
খেলোয়াড় হিসেবে এবং জীবনে আপনার চাওয়াগুলো কি?
একজন খেলোয়াড় হিসেবে আমি কি চাই এ বিষয়ে আমি বহুবার বলেছি। সেটা হলো, আমি জাতীয় দলের জন্য সেরা অর্জনটা পেতে চাই। আপনি বুঝতে পারছেন আমি কি বলতে চাইছি। এখনও আমার সেই সেরা অর্জনটি পাওয়া হয়নি। এছাড়া, ঈশ্বরকে অসংখ্য ধন্যবাদ যে ব্যক্তিগতভাবে ক্লাবগুলোকে সর্বোচ্চ সফলতা আমি এনে দিতে পেরেছি। আর আমার অজর্নও কম নয়।
জীবনের কথা বলতে গেলে বলতে হয়, আমি কখনও ব্যক্তিগত জীবনে শূন্যতা অনুভব করিনি। আমার পরিবারকে আমি পৃথিবীর যে কোনো কিছু থেকে সবচাইতে বেশি ভালোবাসি। তারাই আমার জীবনের সব কিছু। আমি সবসময় তাদের পাশে থাকতে চাই।
শেষ হয়ে যাওয়া খেলাগুলো কি আপনি পরে দেখেন?
না। আমি সেগুলো দেখি না। এমনকি খেলা শেষ হলে সেটার খবরও পড়ার আগ্রহ আমার নেই।
তবে অসাধারণ কোনো খেলা হলে সেটা আমি দেখি। অনেক সময় অনেকে আমার জন্য খেলা রেকর্ড করে রাখে; তখন আমি দেখি। এছাড়াও আমার ক্লাবে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা আমি স্মৃতি হিসেবে আমার কাছে রেখে দেই। কারণ, ভবিষ্যতে এগুলো খুব মধুর স্মৃতি হিসেবে দেখা দেয়।
জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বের ধাক্কা সামাল দেন কিভাবে?
আমি সবসময়ে চাই আগের মত করেই সময় কাটাতে। সব সময়েই চেষ্টা করি যাতে করে কিছুই পরিবর্তন না হয়। তবে কিছু কিছু বিষয় আছে যা এ মুহূর্তে আমার পক্ষে করা খুব কঠিন হয়ে গেছে। যেমন, মুভি দেখতে যাওয়া কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে কোথাও ঘুরতে যাওয়া। তারপরও চেষ্টা করি, আর সবার মতো স্বাভাবিক জীবন কাটাতে।
বিশ্বের এক নম্বর খেলোয়াড় হওয়ার অনুভূতিটা কেমন?
আলাদাভাবে আমার কখনই কিছু মনে হয়নি। এ মুহূর্তে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে খেলে যাওয়া। আমার দলের জন্য ভালো কিছু করাটাই আমার কাজ। তারপর হচ্ছে, আমি কত নম্বরে আছি। সেটা এক, দুই, তিন যে স্থানেই হোক। এগুলো আমার কাছে খুব কম গুরুত্বপূর্ণ।
এই রেটিং পদ্ধতি একজন খেলোয়াড়কে উৎসাহিত করতে পারে বলে কি আপনি মনে করেন?
অবশ্যই। একজন খেলোয়াড়কে তার ভক্তরা বা মিডিয়া সম্মানজনক আসনে নিয়ে গেলে সেই খেলোয়াড়ের জন্য এটা সত্যিই উৎসাহের। সে তখন তার জীবনের সর্ব শক্তি দিয়ে খেলে। কখনই কোন খেলোয়াড় তার ভক্তদের নিরাশ করতে চায় না।
অনেক খেলোয়াড় আছে যারা আপনার মতো হতে চায়। তাদের প্রতি আপনার পরামর্শ কি?
দেখুন, কখনো কেউ কারও মতো হতে পারে না। প্রতিটি মানুষই ভিন্ন ধরনের। একজন মানুষের চিন্তা কখনো আরেকজন মানুষের চিন্তার সাথে মিলে যেতে পারে না। এখানে অবশ্যই নিজস্বতা থাকা উচিত।
তারপরও আপনার খেলার বিশেষত্ব কি?
আমি যখন মাঠে নামি তখন মনে করি এটাই আমার শেষ খেলা। প্রতিটি খেলাকেই মনে হয় শেষ খেলা। আজ যদি কিছু করতে না পারি তাহলে সামনে আমার আর কোন সুযোগ আসবে না। আবার উল্টোভাবে বলতে গেলে, যখন হেরে যাই। তখন হতাশ হই না। মনে করি, সুযোগ এখনও সামনে আছে। হতাশ হওয়ার কিছু নেই।
ভবিষ্যতে আপনি আপনাকে কোথায় দেখতে চান? আর্জেন্টিনা থাকবেন এবং কি করবেন?
এ মুহূর্তে আমি নিজেও জানি না যে কি করবো। আমি মনে করি এখনও আমার অনেক দূর যেতে হবে। সুতরাং বলতে পারছি না ভবিষ্যতে নিজেকে কোথায় দেখতে চাই। তবে আমার পরিবারের সাথে আমি একদিন নিশ্চিন্ত মনে সময় কাটাবো; এ স্বপ্নই দেখি। ঠিক তখন বলতে পারবো কোন কাজটা আমি করবো।
-------------------------------------
মেসি বাংলাদেশে আসবে। উন্মাদনায় ভাসবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে যুক্ত হবে নতুন এক অধ্যায়। খেলার মাঠে যাওয়ার আগে আর্জেন্টাইন দলের সবাইকে যেমন বলা হয়, ‘দ্যা বল শুড বি গিভেন টু মেসি’। আমরাও আশা করি মেসি সেই বলের যাদু ছড়িয়ে দিবে আমাদের বাংলাদেশে। যাতে করে একটি প্রজন্ম ফুটবল নিয়ে জেগে উঠতে পারে। ফুটবলের হারানো ঐতিহ্য এবং ভবিষ্যতে উন্নতমানে ফুটবল খেলোয়াড় বের করে আনতে মেসির আগমণ আমাদের ফুটবলকে নিয়ে যাবে নতুন দিগন্তে।