ঢাকা, রবিবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৮ মে ২০২৫, ২০ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

হিজড়াদের কথা ভাবতে হবে

আদিত্য আরাফাত | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮:১২, সেপ্টেম্বর ৩, ২০১১
হিজড়াদের কথা ভাবতে হবে

২ মার্চ ২০১১। স্থান শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেট।

দুপুর ২টা। দোতলার পাবলিক টয়লেটে এক হিজড়া ঢুকতে চাইলে কয়েকজন মহিলা বলে ওঠেন- ‘মহিলা টয়লেটে কি? পুরুষ টয়লেটে যা’। এরপর পুরুষ টয়লেটের লাইনে দাঁড়ালে পুরুষরা রীতিমতো চেঁচামেচি শুরু করেন। কয়েকজন চিৎকার দিয়ে ওঠে, ‘ওই পুরুষ টয়লেটে ঢুকবি তো হাত-পা ভেঙ্গে দেব। ’ শেষ পর্যন্ত টয়লেটের শৃঙ্খলায় দায়িত্বরত একজন লোক তাকে বের করে দিতে উদ্যত হয়। এতে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয় দুজনের। পরে কাঁদতে কাঁদতে হিজড়া লোকটি চলে যাওয়ার আগে ক্ষোভে সবাইকে গালাগাল করতে করতে বলে- ‘আমাদের খাইতে দিবি না, শুইতে দিবি না, কাজ করতে দিবি না, হাগতেও দিবি না, তাহলে আমরা কই যামু?’

২২ আগস্ট ২০১১। গাবতলীর একটি বাস কাউন্টারে এক হিজড়াকে ঘিরে কয়েকজনের জটলা। কৌতূহলবশত কাউন্টারে গিয়ে জানতে পারি এক হিজড়া বগুড়া যাবে। কিন্তু তার পাশের সিটে কেউ বসতে রাজি নয়। কাউন্টারের লোকজনের এক কথা, যেতে হলে এ হিজড়াকে দুটো সিট একসাথে নিতে হবে। অর্থ্যাৎ হিজড়াটির পাশের খালি সিটও তাকে কিনতে হবে। অনেক বাগবিতণ্ডার পর হিজড়াটি একসাথে দুটো টিকেট কিনতে বাধ্য হয়।

এভাবেই আমাদের দেশে হিজড়া সম্প্রদায় প্রায় প্রতিনিয়ত বৈষম্যের শিকার। তাদের না থাকে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুযোগ, মানুষের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির কারণে থাকে না ব্যবসা করার সুযোগ। ফলে তাদের জীবিকার পথ হয়ে উঠে মানুষের কাছ থেকে চাঁদা তোলা কিংবা অসামাজিক কাজে লিপ্ত হওয়া।

আমাদের দেশে প্রায় সব হিজড়াদেরই বেদনার গল্প রয়েছে। তারা না পায় পরিবারের কাছে আশ্রয়, না পায় সমাজের কাছে। এদের জায়গা কোথাও নেই। অন্য সবার মতোই একজন হিজড়াও কোনো মায়ের গর্ভে জন্ম নেয়। কিন্তু হরমোনজনিত সমস্যার কারণে শারীরিক ভিন্নতা নিয়ে জন্ম নেন কিছু হতভাগ্য মানুষ। এ কারণে কোনো একটা পর্যায়ে স্নেহময়ী মা, দায়িত্ববান পিতা, পরিবার ও সমাজ অস্বীকার তাদের করে।

সমাজের বাকি অংশের মতো সে বাড়ার সুযোগ পায় না। স্কুলে যাওয়ার সুযোগ তার হয় না। সমাজের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য একসময় পরিবারের সদস্যরা তাকে রেখে আসেন হিজড়া সম্প্রদায়ের কাছে। তারপর পেটের দায় মেটাতে রাস্তায় ভিক্ষাবৃত্তি, শারীরিক অঙ্গভঙ্গি, পতিতাবৃত্তি, নতুন কোনো শিশুর জন্ম হলে নাচগানের মাধ্যমে উপার্জন করতে হয় তাদের। আর এ উপার্জনের পথে তাদের সহ্য করতে হয় নানা দুঃসহ অভিজ্ঞতা। রাস্তাঘাটে কটূক্তি আর উপহাস তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। স্বস্তিতে কোথায়ও বস করার উপায় নেই। স্বাভাবিক পরিবেশ বলতে যা বোঝায় সেখানে কেউ তাদের থাকতে দিতে চায় না। ঢাকা শহরের বেশির ভাগ হিজড়াই বস্তিতে বসবাস করেন।

বাংলাদেশ সংবিধানের মৌলিক অধিকার ভাগের ৩৯ অনুচ্ছেদের ২ ধারার `ক` উপধারা অনুয়ায়ী রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। এই বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার সর্বোচ্চ স্বীকৃতি হচ্ছে নিজের পছন্দ অনুযায়ী প্রতিনিধি নির্বাচন। কিন্তু স্বাধীনতার ৩৮ বছর পর্যন্ত এরা ভোট দিতে পারেননি। এ মৌলিক অধিকার থেকে তাদের ৩৮ বছর বঞ্চিত করা হয়েছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তাদের ভোট প্রয়োগের ক্ষমতা দেয়া হলেও অনেক হিজড়ার অভিযোগ, তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। বাংলাদেশের সংবিধান রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির ১৫(ঘ) অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হিসেবেই স্পষ্ট বলছে-

‘সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতাপিতৃহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্খিতিজনিত আওত্তাতীত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারী সাহায্য লাভের অধিকার। ’

এছাড়া মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণায় রয়েছে : দাসত্ব থেকে মুক্তির অধিকার, ভোটের অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার, কাজের অধিকার, মানসম্মত জীবনযাপনের অধিকার, আইনের আশ্রয় ও নির্যাতন থেকে মুক্তির অধিকার এবং বিবাহ ও পরিবার গঠনের অধিকার। অথচ এদের মৃত্যুতে জানাজা হলেও থাকে না মানুষের অংশগ্রহণ। মসজিদ-মন্দিরেও এদের আশ্রয় মেলে না।

ব্রিটিশ আমলে হিজড়াদের বিতাড়িত করা হয় এবং হিজড়াদের যৌনতার বিরুদ্ধে আইন করা হয়। ব্রিটিশ আইনে হিজড়াদের যৌনতাকে সডোমি হিসেবে চিহ্নিত করে এবং পেনাল কোডের ধারা ৩৭৭-তে বলা হয়েছে যে, এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ওদের যৌনতার অধিকার এবং মানবাধিকার নিশ্চিত করার অধিকার রাষ্ট্রের। আট-দশজন মানুষের মতো এরাও রাষ্ট্রের নাগরিক।

বাংলাদেশের সংবিধানে উল্লেখযোগ্যভাবে এ সম্প্রদায়ের ওপর কিছু লেখা নেই। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের কোনও সরকারই এদের বিভিন্ন সেক্টরে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেনি, ফলে হিজড়া সম্প্রদায় পড়ালেখার প্রতিও আগ্রহী হয়ে উঠছে না। কারণ তাদের ধারণা, পড়ালেখা শেষ করলেও সরকার বা কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে না। অথচ এদেরও রয়েছে পরিবারে সম্মানের সঙ্গে বসবাসের অধিকার, চাকরির অধিকার, সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার এবং তাদের ভালবাসা পাওয়ার অধিকার ।

সমাজের স্বাভাবিক আচরণ পেলে এই হিজড়ারাই হতে পারতেন একেকজন স্বাবলম্বী মানুষ। এদের মাঝ থেকেই সৃষ্টি হতো প্রকৌশলী, চিকিৎসক, শিক্ষাবিদ কিংবা কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে খেটে খাওয়া মানুষ। মানবীয় আচরণ ও রাষ্ট্রপ্রদত্ত নিরাপত্তার দ্বারা আমরা অবশ্যই সমাজের চির অবহেলিত এ সম্প্রদায়টিকে সমাজের মূল স্রোতে আনতে পারি এবং তা করতে আমাদের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাও রয়েছে।

বাংলাদেশ সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদের ২ ধারায় বলা আছে, ‘মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করিবার জন্য এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধাদান নিশ্চিত করিবার লক্ষ্যে রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন। ’

সংবিধানের এ নির্দেশনা অনুযায়ী অনগ্রসর শ্রেণী হিসেবে হিজড়া সম্প্রদায়ের উন্নতির জন্য অগ্রাধিকারভিত্তিক কর্মসূচি নেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও বাধ্যবাধকতার মধ্যে পড়ে (সংবিধানের এ নির্দেশনা মোতাবেকই নারী, উপজাতি, অনগ্রসর জেলাসমূহের অধিবাসীদের জন্য সরকার বিশেষ কোটা ও কর্মসূচি গ্রহণ করেছে)। অনগ্রসর এ সম্প্রদায়কে উন্নয়নের স্রোতধারায় নিয়ে আসতে হলে সরকারকে যা করতে হবে তা হলো : এ জাতীয় শিশু জন্মের পরপরই তার হরমোনজনিত ট্রিটমেন্টের সব দায়দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। বাধ্যতামূলকভাবে তার পরিবারের সাথে (পিতা-মাতার সাথে) বসবাসের জন্য আইন করতে হবে। তাদের পড়ালেখা ও কর্মসংস্থানের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

আমরা জানি, একটি দেশের উন্নতি মানে দেশের সব শ্রেণীর জনগোষ্ঠীর উন্নতি। তাই দেশের সকল পর্যায়ের সুষম অর্থাৎ দেশের সার্বিক উন্নতির জন্য আমাদের অবশ্যই এ অবহেলিত হিজড়া সম্প্রদায়কে সমাজের মূল স্রোতে আনতে হবে। বিশ্বের দরবারে নিজেদের একটি সভ্যজাতি হিসেবে পরিচিত করতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই।
 
aditya.arafat1@gmail.com

বাংলাদেশ সময় ১৬১৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৩, ২০১১ ঘণ্টা

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।