কৈশোরে এক আধপাগলকে দেখতাম, সে কথায় কথায় বলে বেড়াচ্ছে, ‘জ্ঞানের কোনো শেষ নেই, জ্ঞানের চেষ্টা বৃথা তাই’। সেই আধপাগলের কথাটার কোনো গুরুতর তাৎপর্য আছে বা কোনো গভীরতর উপলব্ধি থেকে সে এ কথা বলে বেড়াত-- এমন কোনো কারণে আমি আজ তার কথা স্মরণ করছি এমনটা নয়।
জ্ঞানের কোনো বিকল্প নেই এ কথা সত্য, কিন্তু মানুষ অসীম জ্ঞানের সাগরে হাবুডুবু খেয়ে বা জ্ঞানের সাগরে পরিণত হয়ে সত্যকে খুঁজে পায় তাও সত্য নয়। এ বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কী, তা আমরা একটু খতিয়ে দেখতে পারি। কুরআন মজিদে উম্মতে মুহাম্মাদিকে উদ্দেশ করে বলা হয়েছে, ‘কুনতুম খায়রা উম্মাতিন, উখরিজাত লিন্নাছি, তা’মুরুনা বিল মা’রুফি ওয়াতানহাওনা আনিল মুনকার, ওয়া তু’মিনুনা বিল্লাহ। ’ অর্থাৎ ‘তোমরাই উত্তম সম্প্রদায়, যারা মানুষের জন্য বের হবে বা মানুষের জন্য চিন্তা করবে, কল্যাণের পথ প্রদর্শন করবে এবং অকল্যাণের পথ থেকে বিরত করবে আর বিশ্বাস রাখবে আল্লাহর ওপর। ’ এখানে উত্তম সম্প্রদায়ের চারটি বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে। এক. তারা মানুষের জন্য কাজ করবে, দুই. কল্যাণের পথ দেখাবে, তিন. অকল্যাণের পথ থেকে বিরত করার চেষ্টা করবে এবং চার. সত্য ও ন্যায়ের ওপর বিশ্বাস রাখবে।
উত্তম সম্প্রদায় হওয়ার জন্য তো জ্ঞানী সম্প্রদায় অবশ্যই হতে হবে। অজ্ঞান, অশিক্ষিত, কুসংস্কারে আচ্ছন্ন সম্প্রদায় কখনো উত্তম সম্প্রদায় হতে পারে না। জ্ঞানী মানুষ যে অজ্ঞান মানুষের চেয়ে উত্তম-- এ ব্যাপারে কুরআন ও হাদিসে বহুবার অনেক স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। কুরআন মজিদে বলা হয়েছে, ‘তোমরা কি মনে করো, জ্ঞানী এবং অজ্ঞানেরা সমান?’ অর্থাৎ জ্ঞানী এবং অজ্ঞানেরা সমান নয়। এভাবে জ্ঞানী এবং অজ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য করা হয়েছে ইসলামে। সেই সঙ্গে জ্ঞানচর্চার রূপরেখাও তুলে ধরা হয়েছে উপর্যুক্ত আয়াতের মাধ্যমে। জ্ঞান হতে হবে মানুষের জন্য-- মানুষকে কল্যাণের পথে চালিত করা এবং অকল্যাণের পথ থেকে বিরত করার জন্য। আর জ্ঞানের সঙ্গে থাকতে হবে সত্য ও ন্যায়ের ওপর বিশ্বাস।
আজকের মানবসমাজে জ্ঞানের বিস্তার সাধিত হয়েছে উল্লেখযোগ্য রকমের। অবশ্য অজ্ঞানতা থেকে মানবজাতি মুক্তি লাভ করেছে এমন নয়। অজ্ঞানতাও আছে যথেষ্ট। তবে জ্ঞানের উন্নতি হয়েছে আকাশচুম্বী এবং জ্ঞানীর বিস্তার ঘটেছে উল্লেখযোগ্য হারে। তবে জ্ঞান মানুষকে যথার্থ মানুষ বানাতে পারছে বা জ্ঞানীরা উত্তম সম্প্রদায় হয়ে উঠতে পারছে কি না এ ব্যাপারে সন্দেহ আছে। আমরা দেখছি জ্ঞান মানুষকে জ্ঞানপাপীও বানাচ্ছে। জ্ঞান মানুষকে স্বার্থপর বানাচ্ছে, যুদ্ধবাজ বানাচ্ছে। জ্ঞান মানুষকে চতুর, বিবেকহীন, হƒদয়হীন এবং মানবতাবিরোধীও বানাচ্ছে। দেখছি মানুষ দিগভ্রান্তের মতো জ্ঞানের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে, নিজেই জ্ঞানের সাগরে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু সবাই এই জ্ঞানের দ্বারা মুক্তির পথ খুঁজে পাচ্ছে না, জীবনের অর্থ খুঁজে পাচ্ছে না। এই দিগভ্রান্ত জ্ঞানের সাগর মানুষকে বিকৃত মস্তিষ্ক, পাগল বা আধপাগলও বানাচ্ছে। এসব হচ্ছে তখনই যখন জ্ঞান আর মানুষকে মানবকল্যাণের পথে ধাবিত করতে পারছে না।
মানুষ জ্ঞান অর্জন করে জ্ঞানের সাগরে পরিণত হতে চাইবে কি না বা অসীম জ্ঞানের সাগরে হাবুডুবু খাওয়ার চর্চা করবে কি না জানি না। তবে জ্ঞানের চর্চা অবশ্যই হতে হবে জীবনমুখী, প্রয়োজনমুখী এবং অবশ্য অবশ্যই মানব কল্যাণমুখী। এটাই ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি।
লেখক : সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময় ২১২০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৪, ২০১১