ঢাকা, রবিবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৮ মে ২০২৫, ২০ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

শিমুলবনে বাদুড়বাহিনী!

আহমেদ মিলন, শ্রীপুর প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭:৫৭, সেপ্টেম্বর ৭, ২০১১
শিমুলবনে বাদুড়বাহিনী!

শ্রীপুর (গাজীপুর): প্রায় শতবর্ষী এক শিমুল গাছ। দূর থেকে দেখে প্রথমে যে কারো মনে হবে গাছটির প্রতিটি ডালে থোকায় থোকায় ঝুলছে কোনও অজানা ফল।



কাছাকাছি গেলে বোঝা যাবে থোকায় থাকায় ঝুলে থাকা বস্তুগুলো কোনও ফল নয়, এগুলো আসলে উল্টো হয়ে ঝুলে রাত নামার অপেক্ষায় থাকা ঝাঁকে ঝাঁকে নিশাচর বাদুড়ের দল। আর গাছের তলায় চলছে ইঁদুর আর কাঠবিড়ালীর সারাক্ষণ ব্যস্ত ছুটোছুটি। স্তন্যপায়ী অথচ উড়তে সক্ষম বাদুড়ের মুখ থেকে পড়া খাবারের উচ্ছিষ্টে ভাগ বসাতেই তাদের এ শশব্যস্ততা।

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম কাওরাইদের সুতিয়া নদীর পাড়ঘেঁষা ওই শিমুল গাছের ডালে আস্তানা গাড়া হাজার হাজার কলাবাদুড়ের এ দলটি দর্শনীয় বস্তু হয়ে উঠেছে।

স্তন্যপায়ী হয়েও উড়তে পারা ছাড়াও বাদুড়ের চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে রয়েছে চোখহীন হওয়া সত্ত্বেও নির্বিঘেœ চলাফেরা করতে পারা। বাদুড় ওড়ার সময়ে মুখ দিয়ে এক ধরণের শব্দ বের করে। এ শব্দ সামনে থাকা বস্তুতে বাধা পেয়ে ফিরে আসে। শব্দের ফিরে আসার সময় ও কম্পনের মাত্রার ওপর নির্ভর করে সে দিকনির্ণয় আর চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করে। বাদুড়ের এ অসাধারণ কৌশলকে অবলম্বন করে মানুষ তৈরি করেছে রাডার (RADAR, Radio Detection & Ranging) যন্ত্র যা বিমান ও জাহাজ চলাচলসহ অন্যান্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহার হয়ে আসছে।

হায়, এ তথ্য বাদুড় জানে না!

কাওরাইদের ওই গাছের বাসিন্দা নিশাচর প্রাণীগুলো বৃষ্টিতে ভিজে রোদে পুড়ে সারাদিন বিশাল ওই মহীরুহেই ঝুলে থাকে। সন্ধ্যা হলেই তারা খাদ্যের সন্ধানে দল বেঁধে ধীর লয়ে ছন্দময় গতিতে উড়ে চলে চতুর্দিকে। ব্রাম স্টোকারের গাঁ ছমছমে পিশাচ-উপন্যাস ড্রাকুলা যারা পড়েছেন, তাদের মানসপটে এ দৃশ্য অন্যরকম আবহের সৃষ্টি করে। কারণ লেখকের কল্পিত চরিত্র মানুষের রক্তচোষা কাউন্ট ড্রাকুলা নিশিরাতে বাদুড়ের রূপ ধরে উড়ে বেড়ায় শিকারের সন্ধানে। স্তন্যপায়ী হওয়া সত্ত্বেও উড়তে পাড়ার সক্ষমতার জন্য যুগে যুগে বিভিন্ন সভ্যতার মানুষ বাদুড়কে বিভিন্নভাবে দেখেছে। কেউ দেখেছে মৃত্যু, রোগ-ব্যাধি আর অশুভের প্রতীক হিসেবে, আবার কেউ দেখেছে সমৃদ্ধি আর দীর্ঘায়ুর প্রতীক হিসেবে। ডাকিনী বিদ্যা তথা কালাযাদু (কুফরি কালাম, তুকতাক) চর্চাকারীরাও বাদুড়ভক্ত বলে জানা যায়।

শেক্সপিয়রের অমর সৃষ্টি ম্যাকবেথেও আছে বাদুড়ের প্রসঙ্গ। আমাদের এখানে কোমলমতি শিশুরা মজার ছলে ছড়া কাটে:

‘আদুর বাদুড় চালতাবাদুড়/ কলাবাদুড়ের বিয়ে/ টোপর মাথায় দিয়ে/ চামচিকেতে বাজনা বাজায় ঠ্যাংড়া কাঠিতে!’

তবে শ্রীপুরের বাদুড়গুলো হচ্ছে আবহমান বাংলাপ্রকৃতির চিরচেনা চরিত্র- বাস্তবের কলাবাদুড়। এদের বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করলে বিশিষ্ট প্রাণী বিজ্ঞানী শরীফ খান বাংলানিউজকে জানান, এরা খাদ্যের সন্ধানে একশ’ থেকে দেড়শ’ কিলোমিটার পর্যন্ত যেতে পারে। সারারাত খাদ্য সংগ্রহের পর আবার আস্তানায় ফিরে আসে।

গত প্রায় ৫০ বছর ধরে বাঁদুড়গুলো ওই গাছটিতে আস্তানা গেড়ে আছে বলে জানান কাওরাইদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম মন্ডল।

কাওরাইদের পত্রিকা এজেন্সি মদীনা পেপার হাউজের মালিক হুমায়ুন কবীর জিহাদী বাংলানিউজকে জানান, মুক্তিযুদ্ধের আগে গাছটিতে বাদুড়ের সংখ্যা আরো অনেক বেশি ছিল।

প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট, খাবারের উৎস কমে যাওয়া আর একশ্রেণীর মানুষের বৈরি আচরণ এদের স্বাভাবিক বংশবিস্তার আর নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করায় ধীরে ধীরে কমছে তারা সংখ্যায়।

স্থানীয়দের ধারণা, ওই গাছে বর্তমানে প্রায় ৩ হাজার বাদুড় আছে।

তারা জানায়, দূর-দূরান্ত থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে গাছে ফিরে আসে বাদুড়গুলো। গাছে বসে খাবার খাওয়ার সময় কিছু খাবার নিচে পড়ে যায়। সেগুলো খাওয়ার জন্য গাছটির নিচে ভীড় করে ইঁদুর আর কাঠবিড়ালী।

শরীফ খান জানান, লালচে বাদামী রঙের মধ্যে হালকা কালোর ছাপযুক্ত বাদুড় কখনো বাসা বাঁধে না। কলাবাদুড় শীত বা বসন্তে বছরে একবার একটি করে বাচ্চা দেয়। জন্মের পর প্রায় দু’মাস ওরা বাচ্চাকে বুকে আগলে রাখে। সাধারণত কলাবাদুড়ের এক ডানা থেকে অন্য ডানার প্রান্ত ৩ ফুট হয়ে থাকে।

তিনি জানান, এসব বাদুড়ের মল থেকে খুব ভালো মানের সার হয়। তাই যে জমিতে এরা মল ত্যাগ করে সেখানে ফসল খুব ভালো হয়।

তবে বাদুড়ের মল শুধু মাটির প্রাণশক্তি বাড়ানোর টনিক হিসেবেই পরিচিত না, বাদুরের মল যুদ্ধের মারণাস্ত্রেও ব্যবহারের রেকর্ড আছে। মার্কিন গৃহযুদ্ধের সময়ে বাদুড়ের মল দিয়ে কামান-বন্দুকের গুলি-গোলায় ব্যবহৃত বারুদ বানানো হতো।  

স্থানীয় মানুষ মনে করেন, সরকার যদি কাওরাইদের এ কলাবাদুড়গুলোর দেখাশোনার ব্যাপারে সচেতন না হয়, তাহলে একটা সময়ে এসে আমাদের চিরচেনা প্রাকৃতিক পরিবেশের শোভাবর্ধনকারী এসব বৈশিষ্ট্যপূর্ণ প্রাণীর অস্তিত্ব ক্রমশ বিলীন হয়ে যাবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৭, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।