ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

নীড় ছোট ক্ষতি নেই, আকাশ তো বড়!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১১৪ ঘণ্টা, আগস্ট ১৫, ২০১৭
নীড় ছোট ক্ষতি নেই, আকাশ তো বড়! ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর শিল্পকর্ম

ধানমন্ডির শিল্পাঙ্গন আর্ট গ্যলারির একটি কক্ষে কমলা রঙের শাড়ির সাথে মিলিয়ে গলার মালা পরে আড্ডা দিচ্ছিলেন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। তার সঙ্গে রয়েছেন জোছনা মাহবুবা হাবীব এবং কবি সুফিয়া কামালের মেয়ে সাঈদা কামাল।

অনেকদিন পর প্রিয় বান্ধবীর ভাস্ র‌্যের প্রদর্শনী দেখতে এসে তিনজনে মেতে উঠেছেন পুরনো দিনের আড্ডায়।

রাজধানীর ধানমন্ডির ১৩ নম্বর রোডের (নতুন) শিল্পাঙ্গন আর্ট গ্যলারিতে চলছে প্রখ্যাত ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর একক শিল্প প্রদর্শনী ‘মেঘের সঙ্গী’।

বাতিল ও পুরাতন গাছের ডাল, গুঁড়ি, শেকড়, লতা-পাতা, পোড়া কাঠ, শেওলা যুক্ত বাঁশের অংশ, বটের ঝুরি, পরিত্যক্ত হাড়ি কলসি, ধাতব বস্তুর টুকরো সব যেন শিল্পের মতোই তার জীবনের অংশ। এসব নিয়েই তার শিল্প সৃষ্টির অভিনব শিল্পযাত্রা। আর এগুলো দিয়েই তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন বাউল, বন্য প্রেম, প্রকৃতি, বানভাসি, শ্রাবণ কন্যা, জলে ভাসা, মমি মা, আহ্বান, শান্তির প্রতীক, জলপুত্র, নৃত্যের তালে তালে, মৌনতা, ঘরে ফেরা,  মমতাময়ী, ভাবনা, জল কুমারী, মান ভাঙানো, শিশুবেলা, শৈশব, ভোরের পাখি সহ প্রায় শতাধিক ভাস্কর্য।
আড্ডারত ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীস্থাপনাশিল্প ধারার মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে জগতের কোনো কিছুই মূল্যহীন নয়, বরং অমূল্য। কোন বস্তু, বিষয় বা ব্যক্তিকে অবমূল্যায়ন করা একটি অপরাধ। প্রতিটিকে যথাযথ সম্মান ও যত্ন করতে হবে। কারণ সবকিছুর মধ্যেই বিরাজ করে সৌন্দর্য, লালিত্য সুষমা, মহিমা ও মাধুর্য। এই মনোভঙ্গীর চারিত্রিক নৈতিকতা যেমন মানুষের অন্তর্গত চেতনার কথা বলে, তেমনি তার বোধানুভূতিতে শৈল্পিক নৈতিকতার বিষয়টি আপনা আপনিই চলে আসে। আর তাইতো প্রিয়ভাষিণীর ভাস্কর্যগুলো বৃষ্টির মতো স্নিগ্ধ বলে জানান জোসনা মাহবুবা হাবীব।

বাংলানিউজকে তিনি বলেন, প্রিয়ভাষিণী সাধারণত ওর প্রদর্শনীগুলো বর্ষাকালে বেশি করে। আর এজন্যই বোধহয় বৃষ্টির মতো আমাদের মুগ্ধ করে ওর কাজগুলো। তাছাড়া এই শিল্পী এতটাই রাবীন্দ্রিক যে, রবীন্দ্রনাথের গান কবিতা আর বিভিন্ন চরিত্রের প্রভাবও লক্ষ্য করা যায় তার কাজের মধ্যে।

আমাদের দেশে নভেরা আহমেদ ভিতেনাম যুদ্ধে বিধ্বস্ত যুদ্ধ বিমানের দুমড়ানো মুচড়ানো ধাতব অংশ নিয়ে স্থাপনা শিল্প তৈরি করেছিলেন। তারও আগে ভাস্কর বারবারা হেলওয়ার্থ সমুদ্র সৈকতের বালুপ্রাঙ্গণে ছোট ছোট বিভিন্ন আকারের নুড়ি পাথর এবং ঝিনুক খন্ডের মধ্যে বড় বড় ভাস্কর্যরূপের উপাদান কুড়িয়ে পেয়ে সমৃদ্ধ হয়েছেন। শিল্প তাই সর্বদা রহস্যময়। আর তাই এই বিস্ময় বিরাজ করে সর্বত্র।  

এ ব্যাপারে সাঈদা কামাল বলেন, প্রিয়ভাষিণী জীবনকে যেভাবে দেখে, সেটা আমার কাছে বড্ড আশ্চর্য লাগে। ওর স্পিরিট অসাধারণ। আর ওর কাজগুলোও অপূর্ব, দৃষ্টিভঙ্গিটা একদম অন্যরকম। আমরা রাস্তায় দেখি একটা কাঠের টুকরো পড়ে আছে, অথচ প্রিয়ভাষিণী ওই টুকরো থেকেই একটা নতুন কিছু সৃষ্টি করবে। প্রকৃত শিল্পজনেরাই এগুলোর সন্ধান পান। ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী তেমনই একজন অনুসন্ধানী শিল্পী-ব্যক্তিত্ব।

নিজের প্রদর্শনী সম্পর্কে বাংলানিউজের সঙ্গে একান্ত কথা হয় ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর। এ সময় তিনি বলেন, প্রদর্শনী তো পুরানো কথা। তবে প্রতিটি প্রদর্শনী আমার কাছে আমার জন্মদিন উদ্যাপনের আনন্দের মতো লাগে। কাজগুলোর একটিকে অন্যটির থেকে অভিনব মনে হয়, যেন আগেরটার তুলনায় নতুনটা আরো বেশি ভালো।
গ্যালারিতে ভাস্কর্য দেখছেন মৌসুমী চক্রবর্তীএছাড়া বিখ্যাত শিল্পী রফিকুন্নবীর প্রদর্শনী যেখানে ৪/৫টি, সেখানে আমার প্রদর্শনীর সংখ্যা ১৮ ছাড়িয়েছে ভাবলেও বেশ লজ্জা লাগে। তবে আমার ঘরে সবগুলো একত্রে একসাথে রাখার থেকে প্রদর্শনীতে সবগুলো কাজকে আলাদা জায়গা দিয়ে দেখতে বেশ ভালো বোধ করি। এটা অনেকটা আমার প্রিয় শিল্পী রুবি নোমানের গানের মতো, ‘নীড় ছোট ক্ষতি নেই, আকাশ তো বড়’। আমি হাতে একটি সরল রেখাও আঁকতে পারি না, অথচ দৃষ্টি দিয়ে সারাদিন ছবি আঁকি, যোগ করেন গুণী এই শিল্পী।

দর্শকদের ব্যাপারে শিল্পী ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী বলেন, দর্শক আসছে, ভালো লাগছে। এটা তো অনুভবের বিষয়। ভাস্কর্যগুলো দেখার পর দর্শকের মনে যদি অনুভূতি জাগে, তাহলেই আমি সার্থক। আমার কাজ সার্থক।

প্রদর্শনী দেখতে আসেন ধানমন্ডির একটি স্কুলের শিক্ষিকা মৌসুমী চক্রবর্তী। বাংলানিউজকে তিন জানান, ভাস্কর্যগুলো ভীষণ প্রাণবন্ত, একদম হৃদয় ছুঁয়ে যায়। আর সত্যি বলতে শিল্পীর সব কাজগুলোর মধ্য দিয়ে পুরো বাংলাদেশকে খুঁজে পাওয়া যায়।

দর্শনার্থী চারু নাজমুল বলেন, “বাংলাদেশের একমাত্র মহিলা ভাস্কর্য শিল্পী ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধাও। তার প্রতিটি কাজের মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা এবং প্রকৃতি আছে। প্রাণহীন বস্তুগুলোকে তিনি ওনার কাজের মধ্য দিয়ে কতো সুন্দর করে প্রাণ দান করেন!

গত ০৪ আগস্ট (শুক্রবার) শুরু হওয়া এই প্রদর্শনী চলবে আগামী ১৮ আগস্ট (শুক্রবার) পর্যন্ত। প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এই প্রদর্শনী সবার জন্য উন্মুক্ত বলে জানান শিল্পাঙ্গন আর্ট গ্যলারির পরিচালক রুমি রোমান।

বাংলাদেশ সময়: ১৭০১ ঘণ্টা, আগস্ট ১৩, ২০১৭
এইচএমএস/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।