সদ্যপ্রয়াত অ্যাপলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবসকে বলা হতো প্রযুক্তি জগতের পারফেকশনিস্ট। মুদ্রণশিল্পের ব্যাপারে অদম্য ছিল তার সৃষ্টিশীল আবেগ ।
এই মানসিকতার কারণেই জবসের সব পণ্যই এত নিখুঁত। একটা প্রতিষ্ঠানের সিইও বা প্রধান নির্বাহী হিসেবে তিনি শুধু কর্মীদের বিষয় এবং লাভ-লোকসানের দিকেই নজর রাখেননি, সাধারণ নির্বাহীরা যা করেন, বরং তিনি পণ্যের ডিজাইন নিয়েই সবচেয়ে বেশি চিন্তা করেছেন। একটা পণ্য প্রযুক্তিগত ও ব্যবহারিক দিক থেকে কতটা কার্যকর, আরামদায়ক ও দৃষ্টিনন্দন হবে, এ বিষয়টি তার ভাবনার বড় জায়গা দখল করে থাকত। বলা যেতে পারে, পণ্যের সূক্ষ্ম নিয়ে ভাবনায় আচ্ছন্ন থাকতেন জবস।
২০০৫ সালে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্বোধনী বক্তৃতায় জবস পণ্যের ডিজাইয়ের ব্যাপারে তার তীব্র আবেগের কথা স্পষ্ট করে বলেন। তিনি তুলে ধরেন মুদ্রণশিল্পের প্রতি তার বিপুল আগ্রহের কারণ।
বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘সাধারণ শিক্ষা ভালো না লাগায় পড়া শেষ না করেই কলেজ যাওয়া বন্ধ করার পর আমি ক্যালিগ্রাফি শেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। সেরিফ এবং সানস-সেরিফ টাইপের অক্ষর নিয়ে পড়েছি। বিভিন্ন অক্ষরের সমন্বয়ের মধ্যে ফাঁকের বিভিন্ন সীমা এবং মুদ্রণশিল্পকে আরও আকর্ষণীয় করার বিষয়ে পড়াশুনা করেছি। এটা এতই সুন্দর, ঐতিহাসিক এবং শৈল্পিক যে, বিজ্ঞান দিয়ে তা বোঝানো যাবে না। এটা আমাকে অভিভূত করে ফেলল। ’
তিনি বলেন, ‘এর বাস্তব প্রয়োগের ব্যাপারে আমি কখনও স্বপ্নেও আশা করিনি। কিন্তু এর ১০ বছর পরেই যখন আমরা প্রথম ম্যাকিনটোশ কম্পিউটার ডিজাইন করলাম, তখনই তা বাস্তব হয়ে গেল। আমার কল্পিত ডিজাইনের পুরোটাই ম্যাক অপারেটিং সিস্টেমের মধ্যে দিলাম। সুন্দর মুদ্রণশিল্প নিয়ে এটাই ছিল প্রথম কম্পিউটার। ’
জবসের দৃষ্টি ছিল মূলত বিভিন্ন অক্ষরের সমন্বয়ের মাঝে সঠিক ফাঁক ব্যবহার করা। এই বিষয়টিই তিনি তার সারা জীবন ভাবনায় রেখেছিলেন। এর প্রকাশ ঘটেছে সেই ভাবনার শুরুর ২০ বছর পর ম্যাকিনটোশ থেকে আইফোন পর্যন্ত।
আর এই একাগ্রতাই স্টিভ জবসকে অন্য সব সিইও থেকে আলাদা করেছে।
গত আগস্টে স্টিভ যখন অ্যাপলের প্রধান নির্বাহীর পদ ছেড়ে দিলেন, তখন গুগলের প্রকৌশল বিভাগের জ্যেষ্ঠ উপ-প্রধান ভিক গুনদোত্রা জবসের সঙ্গে তার কথোপকথনের কিছু অংশ তুলে ধরেছিলেন। তখনও আইফোন বাজারে আসেনি।
গুনদোত্রা বলেন, এক ‘সকালে স্টিভ আমাকে জরুরি ভিত্তিতে দেখা করতে বললেন। তিনি বললেন, আইফোনে আমি গুগলের লোগোটি দেখছিলাম, লোগোটি আমার কাছে ভালো লাগল না। গুগলের দ্বিতীয় ‘ও’ অক্ষরটিতে সঠিক মাত্রায় হলুদ রঙ দেওয়া হয়নি। এটা একেবারে ভুল এবং আমি কালকেই গ্রেগকে এটা ঠিক করতে বলব। আপনার কাছে কি এটা ঠিক আছে বলে মনে হয়?’
আইফোনের উন্নয়নের পেছনে কয়েক শ ডিজাইনার কাজ করেছেন। কিন্তু তারা ধরতেই পারেননি, গুগলের লোগোতে রংয়ের সামান্য সমস্যা রয়েছে। কিন্তু পারফেকশনিস্ট স্টিভ সেটা ঠিকই ধরেছিলেন।
তবে পণ্যের সার্বিক বিষয় এবং ডিজাইনের ব্যাপারে স্টিভের অসাধারণ মনোযোগের প্রমাণ মিলবে, ম্যাকবুক ল্যাপটপের আল্ট্রাস্লিম ডিজাইন, রং নির্বাচন এবং প্রায় এক মিলিমিটার সাইজের উজ্জ্বল আলোর ব্যবহার। এই আলোকে স্লিপ ইন্ডিকেটর বলা হয়, ল্যাপটপ যখন স্লিপ মুডে অথবা বন্ধ থাকে তখন এটি জ্বলে।
পরে অনেক ল্যাপটপেই এই ধরনের আলো ব্যবহার করা হয়েছে কিন্তু অ্যাপলের মতো হয়নি।
অ্যাপলের স্লিপ ইন্ডিকেটরটি তৈরি করা হয়েছে মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের হারের সঙ্গে মিল রেখে। পূর্ণবয়স্ক মানুষ প্রতি মিনিটে ১২ বার শ্বাস নেয়, ম্যাকের ওই আলোটিও মিনিটে ১২ বার জ্বলে-নেভে।
স্টিভ এভাবেই শিল্পীর দরদ দিয়ে প্রযুক্তিকে উন্নত করে গেছেন। মাত্র ৫৬ বছর আয়ু পেয়েও পৃথিবীকে তিনি হাজার বছর এগিয়ে দিয়ে গেছেন। স্টিভ এমন একজন শিল্পী-উদ্ভাবক, যার কাজের মধ্য দিয়ে তিনি পৃথিবীবাসীকে চিরঋণী করে গেছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৭, ২০১১