পাদ্রি ম্যানরিক ১৬৯২ সালে সেখানে উপস্থিত থাকার সময় পর্তুগিজদের নির্মমতা দেখেছেন। দস্যুতা ও লুটতরাজ করে সম্পদ ও শস্য লুট এবং মানুষজনকে ধরে আনার বিবরণও তিনি তার ভ্রমণ কাহিনিতে উল্লেখ করেছেন।
চট্টগ্রাম উপকূল-কেন্দ্রিক বাংলায় সে সময়ের কুখ্যাত পর্তুগিজ দস্যু ও লুটেরা সর্দার হিসাবে নাম জানা যায় দিয়েগা দ্য স্যা-এর। ত্রাস হিসাবে পরিচিত এই হার্মাদ নেতা পর্তুগিজদের কুকর্মে নেতৃত্ব দিত। একটি ঘটনার বিবরণে জানা যায়, সে তার দলবল ও বহর নিয়ে ঢাকার কয়েক মাইল দূরে একটি বর্ধিষ্ণু গ্রামে হানা দেয়। এই গ্রামে পূর্বে কখনও দস্যুরা গমন না করায় গ্রামের মানুষ নির্বিঘ্নে ছিল। দস্যুদের সম্পর্কে কোনো ধারণাই গ্রামবাসীর মধ্যে ছিল না। দস্যুরা হঠাৎ করে গ্রাম আক্রমণ করায় লোকজন সব কিছু ফেলে পালিয়ে যেতে থাকে। পর্তুগিজরা বিনা বাধায় বিস্তর ধন-সম্পদ হস্তগত করে। একদল মুসলিম অভিজাত নারী পর্দাবৃত গাড়িতে পাহরাদারের সঙ্গে সেই গ্রামের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। দস্যুরা লুটের মালামালসহ ফিরে আসার সময় পথে পেয়ে সেই নারীকেও ছিনিয়ে নিয়ে অংগারখালীতে চলে আসে।
এই বিবরণ দিয়ে ম্যানরিক আরো জানাচ্ছেন যে, লুণ্ঠিত ধন-সম্পদ ও বন্দিদের নিয়ে দস্যুরা বীরদর্পে বিজয়ীর বেশে অংগারখালীতে প্রবেশ করে। এ উপলক্ষে বন্দর ও জাহাজগুলোকে সজ্জিত করা হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে পতাকা উত্তোলন করে কামান ও অস্ত্রের গোলা বর্ষণের মাধ্যমে উল্লাসও প্রকাশ করা হয়।
বস্তুতপক্ষে, দস্যুরা এরূপ আনুষ্ঠানিক ও উৎসবমুখর পরিবেশে গর্বিতভাবে নিজ বন্দরে প্রবেশ করতো এই জন্য যে, যাতে পথিমধ্যে মানুষ তাদের শক্তি ও সফলতা সম্পর্কে জানতে পারে এবং জনমনে তাদের ব্যাপারে ভয় বজায় থাকে। তারা কখনো কোনো অভিজাত নাগরিক বা সুন্দরী নারী লুট করে আনলে সেগুলো প্রদর্শন করে নিজেদের শক্তিমত্তাকে আরো বড় করে প্রদর্শন করতো। বন্দরে প্রবেশ করে দস্যুরা আনন্দ-উল্লাস ও হৈচৈ আরম্ভ করতো এবং নিজেরা একপাশে দাঁড়িয়ে অন্য পাশে বন্দিদের দাঁড় করিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন শুরু করতো। পর্তুগিজ দস্যুদের উন্মত্ততা এবং বন্দিদের আহাজারি মিলে সেখানে এক নারকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো, যা মদ-মাংস ও গান-বাজনা সহযোগে হার্মাদ-পাষণ্ডরা উপভোগ করতো।
পর্তুগিজ দস্যু ও লুটেরাদের হাজার হাজার নারকীয় অপরাধের মধ্যে কয়েকটি ইতিহাসের পাতায় অত্যন্ত ঘৃণিতভাবে স্থান পেয়েছে। একবার এক বন্দি নারী ছিলেন একজন মুঘল প্রশাসনের এক হাজারি মনসবদারের মেয়ে এবং একজন দুই হাজারি মনসবদারের স্ত্রী। তিনি ছিলেন মির্জা পদবীর একজন অভিজাত। তার স্বামীকে যুবরাজ দারাশিকো দিল্লিতে ডেকে পাঠালে বাংলায় অবস্থিত জায়গিরে স্ত্রীকে যথাযথ পাহারায় রেখে মির্জা চলে যান। এই সুযোগে দুর্বৃত্ত পর্তুগিজরা সুন্দরী নারীকে লুট করে চট্টগ্রামে তাদের ঘাঁটি অংগারখালীতে নিয়ে আসে। তারা এমনই বেপরোয়া ও হিংস্র ছিল যে, সাধারণ মানুষ তো বটেই, শাসকদের স্ত্রী-কন্যাকে তুলে আনতেও ভয় পেতো না। দস্যুরা নানাভাবে এই মুঘল রমণীকে শ্লীলতাহানির চেষ্টা চালাতে থাকলে নিরুপায় হয়ে তিনি খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করে মোটামুটি ভদ্রগোছের একজনকে বিয়ে করেন।
এই আপত্তিকর ঘটনা জানাজানি হলে স্বাভাবিক কারণেই দিল্লি ও বাংলার মুঘল শাসক শ্রেণি চরমভাবে ক্রোধান্বিত হয়। সম্রাট শাহজাহান তাৎক্ষণিক এক নির্দেশে বাংলার সুবাদারকে হুগলি থেকে পর্তুগিজদের বিতাড়ন করার নির্দেশ দেন। তখন বাংলার সুবাদার ছিলেন কাসিম খান জুয়ুনি। তিনি ১৬৩২ সালে এক অভিযান চালিয়ে হুগলি থেকে পর্তুগিজদের তাড়িয়ে নিম্নবঙ্গের দিকে আসতে থাকেন। চতুর দস্যুরা তখন আরো দক্ষিণে পালিয়ে গিয়ে আরাকানের রাজার আশ্রয়ে চলে যায়। বাংলা থেকে পর্তুগিজদের বিতাড়নের অনেকগুলো কারণের মধ্যে এ ঘটনাটি অন্যতম।
মূলত সর্বাগ্রে বাংলায় আগমন করলেও দস্যুতা, লুটতরাজ ও বন্যতার কারণে পর্তুগিজরা এখানে টিকতে পারে নি। পর্তুগিজদের নিকৃষ্ট আচরণের জন্য এখানকার সরকার বা জনগণ, কেউই তাদেরকে পছন্দ করতো না। অনেক পরে কূট-কৌশলী ইংরেজরা স্থানীয় কিছু মানুষ এবং সরকারের ভেতরের একটি অংশকে হাত করে ক্রমে ক্রমে বাংলা তথা ভারতের ক্ষমতা লাভ করে প্রায়-দুইশ’ বছর শাসন পরিচালনা করতে সক্ষম হয়।
৫০০ বছর আগে চট্টগ্রামের কোনো এক স্থানে অবস্থিত এবং বর্তমানে হারিয়ে যাওয়া অংগারকেল বা অংগারখালী বঙ্গোপসাগরের অথৈ জলরাশিতে বিলীন হলেও পর্তুগিজ-হার্মাদ বাহিনির অত্যাচার, লুটতরাজ, দস্যুতা ও দাস ব্যবসার নির্মম দৃষ্টান্ত স্বরূপ ইতিহাসের পাতায় কলঙ্কের অক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়ে গেছে।
কোথায় ছিল চট্টগ্রামের পর্তুগিজ নগরী ‘অংগারকেল’?
ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৩০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০১৭
এমপি/জেডএম