যে নাম শুনলে টগবগ করে শরীরের রক্ত, মুহূর্তের মধ্যে চেতনার তন্দ্রা ভেঙে যায়, যে নাম থেকে বিপ্লব শব্দটিকে আলাদা করার কোনও সুযোগ নেই, তিনি চে। চে মাত্র একটি নাম নয়, এটি মানুষের মুক্তিসংগ্রামের অন্তহীন প্রেরণার নাম।
১৯৬৭ সালের ৮ অক্টোবর। বলিভিয়ার ইউরো উপত্যকায় হাত বাঁধা চে-র ওপর মারিও তেরান য়ান নামের এক মদ্যপ সার্জেন্ট গুলি চালায়। তখন ঘড়ির কাঁটায় রাত দেড়টা। পরপর ১০টি গুলির আঘাতে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় বন্দি চে গুয়েভারা-কে।
আর্জেন্টাইন সেই ‘সন্ত্রাসী’ চে-কে মেরে ফেলতে পেরে উল্লসিত হয় বলিভীয় সেনাবাহিনী। তখন তার মৃতদেহের ছবি সারাবিশ্বের সংবাদপত্র ও টিভিতে প্রচারিত হয়। তারপর থেকে যিশুখ্রিস্টের মতো চে হাজির হয়ে যান লাল পোস্টারের মাধ্যমে পৃথিবীর প্রায় সব শহরে, রাস্তায় রাস্তায়, মিছিলে আর স্লোগানে। কিন্তু সেই স্লোগানে পৌঁছায় না নিউইয়র্ক টাইমসে, তাদের কাছে পৌঁছায় শুধু বলিভীয় সেনাবাহিনীর উল্লাস। তাই সে সময় পত্রিকাটি লিখেছিল, ‘একজন মানুষের সঙ্গে সঙ্গে একটি মিথও চিরতরে বিশ্রামে চলে গেল। ’
কিন্তু সেই লেখক বুঝতেই পারেননি বিপ্লবী চে-কে হত্যা করা সম্ভব নয়। মদ্যপ মারিওর ১০টি গুলিতে মারা যায়নি চে-র মতবাদ। খোদ ইউরোপ-আমেরিকার বেশির ভাগ পণ্যের বুকেও এখন সেই ‘সন্ত্রাসী’র ছবি অনেক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় শোভা পায়।
আর বলিভিয়া, কিউবা, আর্জেন্টিনা, ভেনেজুয়েলা, কানাডা, ফিলিস্তিন থেকে শুরু করে ভারত, নেপাল, বাংলাদেশ পর্যন্ত কোটি কোটি মানুষের স্বপ্ন হয়ে আছে অমর চে গুয়েভারার আদর্শ, মিথ। চার দশক আগে নিহত হওয়া এই বিপ্লবী আরও বেশি করে মানুষের অপ্রাপ্তি-বঞ্চনার বিপক্ষে রুখে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা হয়ে উঠছেন।
আর্জেন্টিনায় এখন ছাত্রদের বিক্ষোভ কিংবা নাগরিক অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ করা হচ্ছে চে গুয়েভারার ছবিসংবলিত প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে। ‘চে গুয়েভারা মিউজিয়াম’ নামের এক জাদুঘরে প্রতিষ্ঠাতা এলাদিও গনসালেস বলেছেন, ‘এখন গুয়েভারা আর্জেন্টিনার সব জায়গায় আছেন। তাঁর পুনর্জন্ম হয়েছে বলা চলে। ’
অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই, আপস না করা, চিরন্তন বিপ্লবে বিশ্বাস; পশ্চিমের ‘বিজ্ঞাপন-ব্যবসা’র চে-কে ছাপিয়ে চে-র আদর্শিক এই চেহারা ফুটে উঠেছে উত্তর আমেরিকায়ও।
১৯৬৮ সালের শেষের দিক বাংলাদেশে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াইয়ের প্রস্তুতি চলছে। তারপর ১৯৬৯-এর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির গণঅভ্যুত্থানের জোয়ারে সারা বাংলাদেশ উথাল-পাথাল হয়ে কাঁপছে। নতুন নতুন বিপ্লবী উদ্যোগের সূচনা হচ্ছে। সেই সময় সাংবাদিক রণেশ দাশগুপ্ত দৈনিক সংবাদে ধারাবাহিকভাবে লিখেন লাতিন আমেরিকার মুক্তিসংগ্রাম। সেগুলো পড়ে অন্তর্মুখী মানুষও উদ্দীপ্ত হয়েছিলেন। ঊনসত্তর থেকে একাত্তরের সেই দুঃসাহসিক দিনগুলোয় চে গুয়েভারা ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামীদের কাছে উজ্জ্বল পতাকার মতো। সেই দিনগুলোয় চে-র লেখা `গেরিলাযুদ্ধ` বইটি মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে হাতে ঘুরেছে। মুক্তিযোদ্ধারা তা থেকে গেরিলা যুদ্ধের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। শিখেছেন যুদ্ধের কৌশল। সে হিসেবে বলা যায়, চে আমাদের মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলেন।
নেপালের রাস্তাঘাটে, গাড়ির বনেট, ক্যাফের সাইনবোর্ড কিংবা টি-শার্টসহ সব জায়গাতেই চে। দেশটির তরুণরা তাদের যে কোনো আন্দোলন-সংগ্রামে চের ছবি হাতে রাস্তায় নামতে অভ্যস্ত। তারা জানায়, এতে আন্দোলনে বাড়তি অনুপ্রেরণা পাওয়া যায়।
আন্দোলনকারীদের মধ্যে এই চে-প্রিয়তা লক্ষ্ করা যায় ফিলিস্তিন কিংবা সুদানেও। এই দেশগুলোতেই চে-র যেন সত্যিকারের মুক্তি ঘটেছে। এসব দেশে চে আর শুধু বামপন্থীদের লড়াইয়ের হাতিয়ার হিসেবে আটকে নেই, যে কোনও অন্যায়ের বিপক্ষে আন্দোলনকারীদের প্রতীক। বিশ্বায়নবিরোধী কিংবা যুদ্ধবিরোধী সমাবেশগুলোতেও এখন চে-র প্ল্যাকার্ড। এখানেও ভিন্ন এক লড়াকু হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন মৃত্যুঞ্জয়ী চে গুয়েভারা। এখানেও দাপটের সঙ্গে টিকে আছেন তিনি।
তবে এসব কথা আগেই জানতেন বিপ্লবী চে গুয়েভারা। কারণ মদ্যপ সার্জেন্ট গুলি ছোড়ার আগেই চে-কে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কী ভাবছ তুমি?’ চে তখন স্মিত হেসে জবাব দেন, ‘বিপ্লবের অবিনশ্বরতার কথা ভাবছিলাম। ’ পরক্ষণেই তিনি ওই সার্জেন্টকে বলে উঠেন, ‘কাপুরুষ, মারো, গুলি মারো, তোমাদের গুলিতে মরবে শুধু মানুষটি। ’
সারাবিশ্বের নিপীড়িত, নির্যাতিত মানুষের বিপ্লব, বিদ্রোহ ও উত্থানের আরও শক্তিশালী সহযাত্রী হয়ে সত্যি ফিরে এসেছেন জীবন্ত কিংবদন্তি চে গুয়েভারা।