ঢাকা, রবিবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৮ মে ২০২৫, ২০ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

বদলে যাওয়ার ক্ষণ

মুস্তাইন সুজাত | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯:৩২, অক্টোবর ৯, ২০১১
বদলে যাওয়ার ক্ষণ

[একদিকে প্রিয়জনকে হারানোর শোক, অন্যদিকে সমাজেরই নানা স্বার্থের হিসাব-নিকাশ কীভাবে বদলে একজন অনুভূতিশীল তরুণকে, তার এক নিবিড় বয়ান এই লেখাটি]  

এক
আজ আমি অন্য মানুষ। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলি না খুব একটা।

আবার কখনও কখনও সারা রাত পার করে দিই আড্ডায়। কাউকে দু পয়সা ধার দিয়ে উপকার করি না। আবার কাউকে লক্ষ টাকা দিয়ে দিই এমনিতেই। গায়ে পড়ে কারো উপকার করতে যাই না। আবার নিজের বিপদ জেনেও কারো উপকারে ঝাঁপিয়ে পড়ি মনের ইচ্ছাতেই। কারো ছায়া মাড়াতে মন চায় না। আবার কাউকে না দেখলে পাগলের মতো আস্ফালন করে মন । কারো মুখের কথা বিষাক্ত ঠেকে। আবার কারো গালি লাগে মধুর। অনেকেই আমার জীবন অচল করে দিতে পারে সুযোগে, আবার অনেকে আমার জন্য জীবন দিয়ে দেবে অবলীলায়। অনেকে আমাকে ভাবে বড় দাম্ভিক, অথচ আমি জানি আমি কী? আমি জানি আমার বদলে যাওয়ার ক্ষণ, আমার আজকের এই পথ চলা ।

দুই
আমার বাবা যখন ইন্তেকাল করলেন, ঠিক তখন আমি তাঁর মাথার কাছে দাঁড়িয়ে, বাকরুদ্ধ ছিলাম অনেকটা সময়। চারদিকে কান্নার রোল কিন্তু আমি বোবার মতো এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি। মনের বিরাট শূন্যতা দেখতে পাচ্ছি চোখের ভেতর দিয়ে। চারদিক কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। আহাজারিগুলো করুণ শোনাচ্ছে, মনে হচ্ছে অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে কান্নার ক্ষীণ আওয়াজ। দাঁড়িয়ে থাকা কিছুটা সময় হয়তো কয়েক মিনিট আমার কাছে অস্তিত্বহীন মনে হয়েছে। আমি দাঁড়িয়ে আছি কোনো এক অচেনা জনশূন্য প্রান্তরে, আমার ভেতর-বাহির সব শূন্যতায় ছেয়ে গেছে। কী যেন এক অতীব অবলম্বন আমার কাছ থেকে দূরে সরে গেছে। মনে হচ্ছে আমার সব কিছুই নির্দিষ্ট বলয়ে বন্দি। আমার দৃষ্টি যেন সীমাবদ্ধ গোলকে আটকে আছে। শূন্যতার এক ঘোরে আছি আমি। চারপাশের কান্নার শব্দ, আহাজারি-বিলাপ আমার কাছে পালকের মতো হালকা ঠেকছে। দরজার পাশে আলমারিতে হেলান দিয়ে আমি বিস্ময়করভাবে তাকিয়ে দেখছি, কারো মুখে উচ্চারিত হচ্ছে দরুদ শরিফ, কেউবা করছে তিলাওয়াত। আসলে যেন বিশ্বাসই করতে পারছি না বাবা বেঁচে নেই। তাঁকে ছাড়া আমাদের যে বাঁচা সম্ভব, অথচ তাঁর সঙ্গ তাঁর স্পর্শ তাঁর ভালোবাসা সব কিছুই যে খুব দরকার! কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না ঘটে যাওয়া কয়েক ঘণ্টার এই ঘটনা। উপস্থিত সবার কণ্ঠেই সহানুভূতি। সবার দৃষ্টি মায়াভরা। হয়তো এমনই হয় সকলের বেলায়, ঠিক এই সময়টা যখন আসে।

তিন
তখন কেবল সন্ধ্যা। বাবা ঘুমিয়ে আছেন তাঁর অতি পরিচিত খাটে। নিশ্চল নিশ্চুপ নিদ্রা। কোনো সাড়া নেই অথচ এই কিছুদিন আগেও যখন আমাকে সাথে নিয়ে ঘুমাতেন, সারা রাত শব্দ করতেন একনাগাড়ে? প্রচণ্ড নাক ডাকার অভ্যাস ছিল তাঁর। আর আজ জীবনের সব মায়া ছাড়িয়ে চলে গেলেন। মাথার কাছে বসা হাফেজ ভাই তিলাওয়াতে মশগুল। ছোট কাকা, মিয়া ভাই, বড় চাচার অশ্রুভেজা চোখ। বড় ভাই পায়ের কাছে বসা। আগরবাতি জ্বলছে ঘুমন্ত বাবার সিথানে। তখনও আমি শূন্যতার দেশে। কে যেন বলছে, ‘ওরে ধর নাইলে পইড়া যাইব’। কেউ একজন আমাকে এসে ধরে ভিতরঘরের দিকে নিয়ে গেল। রাস্তা আগলে কে একজন আমাকে জড়িয়ে ধরে(হয়তো চাচাতো বোনদের কেউ হবে)বিলাপ করে উঠল আর ঠিক তখনই আমি কেঁদে উঠলাম প্রথম বারের মতো। বুকের ভেতরের গুমরে থাকা কষ্টগুলো বেরিয়ে এল চোখের জল আর কান্নার হেচকি হয়ে। আমাকে বসানো হলো পেছনের বারান্দায়, মোড়া পেতে। অঝোর ধারায় কেঁদেছি শ্রাবণের ঢলের মতো প্রচণ্ড বুকভাঙ্গা কষ্টে। মায়ের আহাজারি, আপার বিলাপ আর ছোট বোনের কান্না কষ্টের মাত্রা বাড়িয়েছে শতগুণ। সেই থেকে আজও আমি কেঁদে চলেছি বাবার জন্য। সবার অগোচরে, সবার অজান্তে। আমার একান্ত অবসর ভাবনাতে, বিনিদ্র রজনীতে কিংবা সংকুল পরিস্থিতিতে। কারণ আজ আমার চিন্তা সবাইকে নিয়ে, যা একদিন ছিল শুধুই বাবার। সেদিন আমার পাশে ছিলেন বাবা স্বয়ং আর আজ আমার মনে শুধুই তাঁর স্মৃতি, তাঁর ছবি। আমার কান্না শুধুই আড়ালে, হৃদয় গহীনে। আমি জানি বাবা হারানোর কষ্ট, বাবাকে না দেখার কষ্ট, অতি প্রিয় বাবা না থাকার দীনতা। সেদিন সারা রাত আমার ঘুমন্ত বাবার পাশে অবিচল বসা ছিলেন গোটা কয়েক মানুষ। তারই প্রিয়জনরা : বড় চাচা, ছোট কাকা, মিয়া ভাই, মামা। হয়তো আরও কেউ কেউ, মনে পড়ছে না সব ঠিকমত। রাতেই সংবাদ ছড়িয়ে দেওয়া হলো মাইকযোগে। দীর্ঘ রজনী পেরিয়ে সকালের আলোয় আত্মীয়-অনাত্মীয়, পাড়া-প্রতিবেশী, শুভানুধ্যায়ীরা আসতে লাগলেন। তাদের মধ্যে অনেকেই কেঁদেছেন নির্জনে, অনেকের চোখ অশ্রুতে ভিজেছে সবার সামনেই। কিন্তু আমার চোখের জল শুকিয়ে মরুভূমি। আবেগরুদ্ধ আমার কণ্ঠ। আমার কান্না পাচ্ছে না, তাই আমি কাঁদতে পারছি না। অনুভূতিহীন এক অন্য মানুষ আমি ।

চিরবিদায়ের কাজ চলছে। বড় ভাই নিজ হাতে গোসল করালেন। আমি পারিনি কেন তা জানি না । হয়তো পারতাম কি না তাও জানি না। অন্যদিকে চলছে কবর খোঁড়ার কাজ। জীবনের প্রথম বাবা না থাকার ধাক্কা।

‘তরা আর একটু পইসমে কবরটা খুঁড়। আমরা কবরস্থানের পুবের পথডা বড় কইরা গাড়ি যাইবার রাস্তা করার কথা সিদ্ধান্ত নিসি। ‘
এই আমরা কারা? শোকের ওপর মিছরিরই ছুরি বর্ষণ ।

‘এই পথ তো আমরার নিজস্ব সম্পত্তি। আমরা তো সবাইরে চলার লাইগগা চাইর আত দিয়া রাকসি। ‘ আমার প্রথম প্রতিবাদের প্রতিউত্তরে, ‘পথ তো সবই সরকারি। ’

‘ঠিক আছে, যদি এইডা আমরার না অইয়া সরকারি অয় তইলে আমরা কবর অন্য জায়গাতে হরাইয়া নিমু। অহন এইহানে কবর অইব। ‘ আমার দ্বিতীয় প্রতিবাদ ।

হয়তো আমার কথায় দৃঢ়তা ছিল কিংবা কাঠিন্য। তাছাড়া চরম সত্যতা যে ছিল আমি নিশ্চিত। ফলে কেউ দ্বিরুক্তি করতে সাহস করেনি। কিন্তু চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে, যার (আমার জীবিত বাবার) কথা ছাড়া বাড়ির কেউ কোনো কঠিন কাজে সাহস পেত না, যার কাছে সবাই ছুটে আসত উপকারের আশায়, তাঁকে এখনও দাফন করা হয়নি, তাঁর আগেই এই চিন্তাভাবনা বাড়ির লোকের? নিজের জায়গায় দাফন করতে গিয়ে প্রতিবাদী হতে হয় তাঁর সন্তানদের : অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, ভয়াবহ । তখনই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম আমাকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে।

বাংলাদেশ সময় ১৯৩২ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৯, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।