১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল, রাত ১০টা। কয়েকজন স্বাধীনতাকামী বিপ্লবী ব্রিটিশ পুলিশ ও সহায়ক বাহিনীর চট্টগ্রামে অবস্থিত অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করতে মাঠে নামে।
সফল অভিযানের পর বিপ্লবী দলটি পুলিশ অস্ত্রাগারে সমবেত হয়ে মাস্টারদা সূর্য সেনকে মিলিটারি স্যালুট প্রদান করে। আর এ সময় সূর্য সেন জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার ঘোষণা করেন।
ব্রিটিশবিরোধী বিভিন্ন বিপ্লবের পরিকল্পনা ও নেতৃত্ব দেওয়া মাস্টারদা সূর্য সেন এ উপমহাদেশে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তার বীরত্ব ও আত্মত্যাগ এ উপমহাদেশকে বিদেশী শক্তির শাসন থেকে মুক্ত করে স্বাধীনতাপ্রাপ্তির স্বপ্ন দেখিয়েছিল। উমাতারা কলেজে শিক্ষকতা করায় তিনি মাস্টারদা নামে পরিচিতি পান।
সূর্য সেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে চট্টগ্রামে অনুরূপ সেন, চারুবিকাশ দত্ত, অম্বিকা চক্রবর্তী এবং নগেন্দ্রনাথ সেনসহ কয়েকজনকে নিয়ে একটি গোপন বিপ্লবী সংগঠনের কাজ শুরু করেন। ১৯২০-এ মহাত্মা গান্ধী বিপ্লবীদের কাছে এক বছরের স্বরাজ এনে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন এবং অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন। এ সময় কলকাতার যুগান্তর দলের সঙ্গে মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের বিপ্লবীরাও ইংরেজবিরোধী প্রকাশ্য আন্দোলনে যোগ দেয়।
মহাত্মা গান্ধী যখন অহিংস আন্দোলন প্রত্যাহার করেন তখন সূর্য সেনের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা আবার গোপনে সশস্ত্র আন্দোলনের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেন এবং অস্ত্র সংগ্রহ করতে থাকেন।
১৯২৩-এ সূর্য সেনের সহযোগীদের নেতৃত্বে সশস্ত্র আন্দোলনের অর্থ সংগ্রহের জন্য রেলওয়ের ১৭ হাজার টাকা ছিনতাই করা হয়। এরপর পুলিশ তাদের আস্তানায় হানা দিলে পুলিশের সঙ্গে যুদ্ধ হয়। যা নাগর থানা পাহাড় খণ্ডযুদ্ধ নামে পরিচিত।
এ যুদ্ধে সূর্য সেন ও অম্বিকা চক্রবর্তী ধরা পড়েন। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী-প্রমাণ না থাকায় তারা দ্রুত ছাড়া পান। ১৯২৬ সালে টেগার্ট হত্যা চেষ্টার পর তিনি কলকাতায় গ্রেপ্তার হন। মুক্তি পান ১৯২৮ সালে।
১৯২৯ সালের প্রথম দিকে তিনি চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেসের সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ সময় সূর্য সেনের দলের উদ্যোগে চারটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৩০ সাল থেকেই তার উদ্যোগে ভবিষ্যৎ সশস্ত্র আন্দোলনের জন্য ব্যাপক আয়োজন শুরু হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুট, জালালাবাদ পাহাড়ে কয়েকশ নিয়মিত সেনার সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ব্রিটিশ শাসনের প্রায় দেড়শ বছরের গৌরব ধুলোয় মিশে যায়। বিপ্লবীদের কাছে ব্রিটিশ আর্মি পরাজিত হয় এবং পিছু হটে।
সশস্ত্র যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর ইংরেজ সরকার সূর্য সেনকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করে। ১৯৩৩ সালে এক বাড়িতে গোপনে অবস্থানের সময় একজন নিকট-আত্মীয়ের বিশ্বাসঘাতকতায় ধরা পড়েন তিনি। বিচারে প্রত্যক্ষ সাক্ষী-প্রমাণ না থাকলেও ইংরেজ সরকারের আদেশে তার ফাঁসির আদেশ হয়।
চট্টগ্রাম জেলে ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি মহান এই বিপ্লবীর ফাঁসি দেওয়া হয়।