তার মানে কি, হাতের লেখার প্রয়োজনীয়তা ফুরোচ্ছে মানবসভ্যতা থেকে? হাজার হাজার বছর স্থায়ী এ চর্চার কি বিনাশ ঘটতে চলেছে মাত্র কয়েক যুগ আগে উদ্ভাবিত প্রযুক্তির আগ্রাসনে? প্রযুক্তির জাদুবলে মানুষ কি ভুলে যাবে কাগজে কলম ঠেকিয়ে হাত ঘুরিয়ে লেখার কায়দা-কানুন?
বর্তমানে যারা পেশা হিসেবে লেখালেখিকে বেছে নিয়েছেন, হাতে লেখার চাইতে টাইপিংকেই তারা প্রথম পছন্দ হিসেবে বেছে নিচ্ছেন।
প্রগতিশীল লেখিকা, শিশুসাহিত্যিক ও অনুবাদক শিমন শারমিনও লেখালেখির সব কাজ করেন নিজের ল্যাপটপে।
মানুষ যা ভাবছে তা ধরে রাখার পদ্ধতিটির নাম ‘লেখন’। শুরুতে ছবির মাধ্যমে মনের কথা লিখে রাখত মানুষ। পরে উদ্ভাবিত হয়েছে সংখ্যা, অক্ষর ও বিভিন্ন সাংকেতিক চিহ্ন। আর শুরু থেকেই হাত ঘুরিয়ে আঁকাবাঁকা সংকেত ফুটিয়ে তোলার মাধ্যমেই এর চর্চা করে গেছে মানুষ।
মানুষ ঠিক কবে থেকে লিখতে শুরু করল তার সঠিক হিসাব জানা যায়নি। তবে প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, মানুষের সবচেয়ে প্রাচীন সত্যিকারের হাতের লিখার প্রচলন ঘটে খ্রিস্টপূর্ব ৩২০০ থেকে ৩১০০ সালে মেসোপটেমিয়ার (বর্তমান ইরাক) সুমেরিয়ান সভ্যতায়। মিশরে শুরু হয় ৩১০০ খ্রিস্টপূর্বে এবং চীনে ১২০০ খ্রিস্টপূর্বে।
আবার অক্ষর আবিষ্কারের জনপ্রিয় মতবাদগুলো ঘিরে রয়েছে নানান অলৌকিক কাহিনী ও গালগল্প। ভারতীয় উপকথা মতে, দেবতা ব্রহ্মা ভারতবর্ষের প্রাচীন লিপিগুলোর উদ্ভাবন করেছিলেন এবং তার নামানুসারে এ লিপির নাম হয় ব্রাহ্মীলিপি। মিশরীয় উপকথা মতে, পাখির মতো মাথা ও মানুষের মতো দেহবিশিষ্ট দেবতা থথ্ সৃষ্টি করেছিলেন মিশরীয় লিপি।
অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, ঈশ্বর প্রদত্ত জ্ঞানকে সংরক্ষণ ও চর্চার জন্য মানুষ লিখতে শুরু করে। অক্ষরগুলো আরও শৈল্পিকভাবে ফুটিয়ে তুলতে বিকাশ ঘটলো ক্যালিগ্রাফির। ভালো হাতের লেখা আয়ত্ত করা ব্যক্তিদের ছিল সমাজে আলাদা কদর। এমনকি এখনও স্কুল-কলেজের পরীক্ষার খাতায় সুন্দর হাতের লেখাকে প্লাস পয়েন্ট হিসেবে দেখা হয়।
এদিকে এখন কম্পিউটার, স্মার্টফোন, কি-বোর্ড এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে, দিনের পর দিন কাগজে-কলমে কিছু না লিখলেও চলে যায়। যুক্তরাজ্যর ‘ডকমেইল’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান ২০১২ সালে এক জরিপ চালায়। জরিপে দুই হাজার মানুষকে প্রশ্ন করা হয়েছিল তারা শেষ কবে হাতে লিখেছেন। উত্তর আসে, গড়ে ৪১ দিন আগে।
শিশুদেরকে কি এখন হাতে লেখা শেখানোর দরকার আছে? তাদের টাইপিং শেখানোই কি উচিত নয়? কারণ কিছু দেশ এরইমধ্যে তাদের স্কুল কারিকুলামে হাতে লেখা শেখানো ঐচ্ছিক বিষয়ে পরিণত করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিয়ন রাজ্যে এক আইন পাস করে বলা হয়েছে, স্কুলের শিক্ষার্থীদের ‘কার্ভিস’ কায়দায় ইংরেজি লেখার প্রয়োজনীয়তা নেই। ইংরেজি অক্ষরগুলো বিশেষ কায়দায় যুক্ত করে লেখার পদ্ধতিকে বলা হয় কার্ভিস। আগে এভাবে ইংরেজি লেখার জন্য জোর দেওয়া হলেও, এখন বলা হচ্ছে এটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়।
অনেকেই হয়তো খেয়াল করে থাকবেন এখনকার কোনো কোনো শিশু হাতে লেখার চেয়ে টাইপ করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। টাইপ করার সময় অক্ষরগুলো একদম নিখুঁতভাবে ফুটে ওঠে। ভুল করলে কাটাকাটি হওয়ার ভয় নেই। লেখার স্টাইল পছন্দ না হলে ইচ্ছামতো ফন্ট পরিবর্তন করে নেওয়া যায়। লেখার গতিও দ্রুততর হয়।
এখন যে শিশুটি হাতে লেখার বদলে টাইপ করাই প্রথম পছন্দ হিসেবে বেছে নিয়েছে, ভবিষ্যতে সে যখন একজন প্রতিনিধিত্বশীল নাগরিকে পরিণত হবে, তখন হাতে লেখার প্রাচীন পদ্ধতিটি ছুড়ে ফেলার পক্ষেই হয়তো সে সমর্থন দেবে। কাগজে ঘষাঘষির তুলনায় টাইপ করাকে খুশি মনেই স্বাগত জানানো হবে।
তবে হাতে লেখা এতো সহজে হারিয়ে যাবে না বলে মনে করেন তরুণ সাংবাদিক হোসাইন মোহাম্মদ সাগর। পেশার খাতিরে লেখালেখির কাজটা কি-বোর্ডে করলেও জরুরি নোট লেখার জন্য কাগজ কলমই তার ভরসা।
সাগর মজা করে বলেন, যতোদিন না আমরা যা ভাবছি তা স্বয়ংক্রিয় উপায়ে লিখে ফেলার প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হচ্ছে, অন্তত ততোদিন হাতে লেখার চর্চাটা থাকবে।
২০০৫ সালের একটি জরিপে বলা হয়, হাতে লেখা শিখলে শিশুরা অপেক্ষাকৃত ভালো অক্ষর চিনতে পারে। ২০১৫ সালের একটি জরিপে দেখা গেছে, শিক্ষকের লেকচার টাইপ করার বদলে হাতে লিখে নিলে তা বেশি মনে থাকে।
টাইপিং-এর তুলনায় হাতে লেখা সস্তা ও সহলভ্য। প্রযুক্তির দিক থেকে যেসব অঞ্চল পিছিয়ে সেখানে হাতে লেখাই বেশি সুবিধা দেবে।
তাছাড়া হাতে লিখতে জানাটা মানুষের একটি বিশেষ দক্ষতা। কম্পিউটারে ডিজিটাল ছবি আঁকার পদ্ধতি আবিষ্কারের পরও হাতে আঁকা ছবির শৈল্পিক মর্যাদা আলাদা। এজন্য দরকার হয় ছবি আঁকার বিশেষ দক্ষতা। হাতে লেখার ব্যাপারটিও মানুষ দীর্ঘদিন চর্চার মাধ্যমে আয়ত্ত করে। আর এর শৈল্পিক সত্তার কারণেই মানুষ হাতে লেখার চর্চা চালিয়ে যাবে বলে আশাবাদী হওয়াটা অযৌক্তিক নয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৮২৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ২২, ২০১৮
এনএইচটি/জেএম