[প্রায় এক দশক হতে চলছে আয়ারল্যান্ডে বসবাস করছি। এ দীর্ঘ সময় এখানে থাকার ফলে আইরিশদের খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে।
বাংলাদেশের মতো সবুজের সমারোহে আটলান্টিক বেষ্টনীতে ব্রিটেনের অদূরেই দাঁড়িয়ে আছে আয়ারল্যান্ড নামের দ্বীপটি। বর্তমানে আয়ারল্যান্ড দুটো ভাগে বিভক্ত। একটি নর্থ আয়ারল্যান্ড। এটি এখনো ব্রিটিশদের সাথে সংযুক্ত। অন্যটি রিপাবলিক অব আয়ারল্যান্ড যা একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বর্তমান বিশ্বে পরিচিত।
একসময় এ দ্বীপটিও ব্রিটিশদের কলোনি হিসেবেই পরিচিত ছিল। সময়ের বিবর্তনে নিজেদের প্রচেষ্টায় দেশটি আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। ব্রিটিশ শাসন মুক্ত হওয়ার পর একসময় দেশটিতে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে না খেয়ে মারা যায় কয়েক লাখ লোক। অভাবের তাড়নায় তাড়িত হয়ে কর্মসন্ধানের উদ্দেশে তারা চলে যায় আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশে।
পরবর্তীকালে সততা, কর্মক্ষমতা ও পর্যটন শিল্পকে ঢেলে সাজিয়ে এবং নিজেদের প্রাচীন ঐতিহ্য ও কৃষ্টিকে ধরে রেখে বিদেশীদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয় যা দেশটিকে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়। আজ এখানে কেউ আর না খেয়ে মরে না। কাজকর্ম না থাকলেও সরকারি ভাণ্ডার আছে। সোশাল ওয়েলফেয়ারের আওতাধীন হয়ে সবাই এ সুযোগ নিতে পারেন নির্দ্বিধায়।
ব্রিটিশদের কলোনি হিসেবে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের আচার-আচরণ, কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের বেশ মিল পাওয়া যায়। ব্রিটিশ আমলে বাংলাদেশে যেমন জমিদারপ্রথার প্রচলন ছিল এখানেও একই রকম প্রথার অস্তিত্ব বিদ্যমান। তবে তারা জমিদারকে লর্ড বলে আখ্যায়িত করত। বিভিন্ন বিচার-আচার, দাবি-দাওয়া ইত্যাদি কাজ সম্পাদনের জন্য সাধারণ মানুষরা এই লর্ডদের শরণাপন্ন হতো।
জমিজমা (যদিও গম ও ভুট্টা ছাড়া চাষাবাদের জন্য একেবারেই অনুপযুক্ত), ফার্ম (গরু ও মেষ) ইত্যাদি বিষয়গুলো লর্ডদের ইচ্ছ-অনিচ্ছার ওপরই নির্ভর করত। তিনি যাকে যেভাবে দেওয়ার প্রয়োজন মনে করতেন সেভাবেই দিতেন। লর্ডদের বাড়িগুলো এখনো দাঁড়িয়ে আছে আইরিশ ঐতিহ্যের এক বিরাট সাক্ষী হয়ে। প্রতিটি বাড়ি এখন একেকটি ক্যাসল হিসেবে পরিচিত। আয়ারল্যান্ডের বিভিন্ন কাউন্টিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এসব ক্যাসল দেখতে বিদেশিরা এসে ভিড় জমান প্রতিনিয়ত। কোনো কোনো ক্যাসলে রয়েছে ছোটখাট মিউজিয়াম, যেগুলো ধারণ করে চলছে আইরিশদের অতীত ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে।
কাউন্টি হচ্ছে বাংলাদেশের একেকটি জেলার মতো। ২৬টি কাউন্টির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে রিপাবলিক অব আয়ারল্যান্ড। প্রতিটি কাউন্টি গড়ে উঠার পেছনেই রয়েছে লর্ডদের ছোটখাটো ইতিহাস। বিভিন্ন কাউন্টিতে অবস্থানরত পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে গেলে দেখা যায় সেখানকার দেয়ালে নোটিশ বোর্ডের আকৃতিতে টানিয়ে রাখা হয়েছে বিভিন্ন শৈল্পিক কারুকাজসম্পন্ন ছবি, যা থেকে সহজেই এগুলো প্রতীয়মান হয়।
পুরো দেশটাকে মনে হয় আমাদের দেশের মতো সবুজ চাদরে ঢেকে আছে। পার্থক্য হচ্ছে, আমাদের দেশের মতো এত নদী-নালা বা খাল-বিল নেই। শহর-বন্দর বা গ্রামগুলোর মধ্যে পার্থক্য করা বেশ কঠিন।
একটা ভিলেজের নমুনা দিই। আমি যে ভিলেজটিতে বসবাস করি তার নাম এডার। লিমরিক সিটি থেকে বারো মাইল দূরে। এ গ্রামে রয়েছে একটি ফাইভ স্টার ওয়ার্ল্ড লিডিং ও দুটো ফোর স্টার হোটেল, ব্যাংক, পাব, পোস্ট অফিস, লাইব্রেরি, ক্যাফে-রেস্তরাঁ, হ্যারিটেজ সেন্টার, শত বছরের ঐতিহ্যবাহী দুটো কটেজসহ (যা দেখতে প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী ভিড় জমায়) কয়েকটি অত্যাধুনিক শপিং মল। রাস্তা-ঘাটের কথা নাইবা বললাম। আশা করি এ থেকেই পাঠকরা এখানকার মানুষদের জীবনযাত্রার মান সম্পর্কে একটা ধারণা নিতে সক্ষম হবেন।
ভাষা ও আঞ্চলিকতার দিক থেকে আইরিশরা চার ভাগে বিভক্ত ছিল, যদিও এখন এসবের কোনো অস্তিত্বই নেই। এগুলো হলো মনস্টার, লিনস্টার, আলসটার ও করডিয়াক। যতটুকু জানা যায়, লর্ডদের কাছে নিজেদের পরিচয় সহজে তুলে ধরার জন্যই মূলত এ বিভক্তির কারণ।
যে অঞ্চলের লোকেরা আইরিশ বা নেটিভ ভাষায় কথা বলত এবং শিক্ষাদীক্ষায় খুব বেশি একটা উন্নত ছিল না, তারা লর্ডদের সংস্পর্শে যেতে পারত না। পক্ষান্তরে যে অঞ্চলের লোকেরা শিক্ষাদীক্ষায় উন্নত ছিল, লর্ডদের সংস্পর্শে গিয়ে কাজকর্ম করত, ইংরেজিতে কথা বলত, তারাই উঁচু শ্রেণীর লোক বলে গণ্য হতো। বর্তমানে যদিও স্কুলে আইরিশ শেখানো হয়, তারপরও আইরিশ ভাষার কোনো প্রচলন বা ব্যবহার কোথাও নেই। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য সর্বক্ষেত্রেই ইংরেজি ভাষার প্রচলন। তবে আমাদের দেশের মতো এখানকার ইংরেজি ভাষাটিও আঞ্চলিক টান (accent) বা শাব্দিক ভিন্নতার প্রভাবমুক্ত নয়। বাংলাদেশে যেমন কারো কথা বা ভাষার ভেতর তার নিজ অঞ্চলের টান লুকিয়ে থাকে, তেমনি এখানেও এর ব্যতিক্রম নয়। তাদের কথা বা এক্সেন্ট শুনেই সহজে উপলব্ধি করা যায় তিনি বা তারা কোন এলাকা বা কাউন্টির।
আইরিশদের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো তারা সাধারণত কাজেকর্মে ফাঁকি দিতে জানেন না বা কাজের প্রতি তাদের কোনো অবহেলা বা কর্মক্ষেত্রে নিন্দাচর্চা নেই। একজন নিম্নমানের লোক যে কাজটি করেন, তা কোনো কোম্পানির মালিক বা ম্যানেজারিয়াল লেভেলের লোকও করতে দ্বিধা বোধ করেন না। একদিন এক মাল্টিপল কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজারকে কার্পেট ভ্যাক্যুম করতে দেখে আমার তো আক্কেল গুড়ুম। কিন্তু এ সবই হলো ওদের সংস্কৃতি। তাদের সহজ হিসাব, কাজ করবে, খাবে-দাবে আর জীবনকে উপভোগ করবে। আমাদের মতো তাদের এত পিছুটান নেই। একজন রোজগার করে পুরো পরিবার টানার সংস্কৃতি তাদের নেই।
একবার এক আইরিশ প্রৌঢ় ভদ্রলোক আমার ওপর ক্ষেপেই গিয়েছিলেন। তাঁর উপযুক্ত ছেলে আয়-রোজগার করে তাকে কোনো সাহায্য-সহযোগিতা করেন কিনা জানতে চাইলে ভ্রূ কুঁচকে উত্তরে বললেন, আমি কেন তার সহযোগিতা নিতে যাব? সে ইয়াং ম্যান, এনজয় করার প্রকৃষ্ট সময় তার। অথচ আমাদের দেশের চিত্র ঠিক তার উল্টো।
এখনকার আইরিশদের মধ্যে ভেদাভেদ খুঁজে পাওয়াটাও বেশ কঠিন। কোটিপতি বস যে বাড়িতে বসবাস করেন, যেভাবে গাড়ি হাঁকিয়ে চলেন, যে রেস্টুরেন্টে গিয়ে খান, যে পাবে মদ্যপান করেন কিংবা যে শপিং মলে বাজার করেন, একজন অল্প বেতনের কর্মচারীও ঠিক সেভাবেই জীবনযাপন করেন। এখানকার সমাজ-কাঠামো এমনভাবে গড়ে উঠেছে যে কেউ ইচ্ছে করলেও সে সংস্কৃতির দেওয়াল সহজে ভাঙতে পারবেন না। তবে দু-একটি ক্ষেত্রে যে তার ব্যতিক্রম নেই তা হলফ করে বলা মুশকিল।
আইরিশরা যথেষ্ট উদার ও সহায়ক। কোনো বিপদ-আপদে সহযোগিতা চাইলে নিঃস্বার্থভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। অকারণ ব্যবসায়িক মনোভাব নেই বললেই চলে। একজন ক্রেতাকে জোর করে কিংবা ভুলিয়ে-বালিয়ে ভুল জিনিসটি গছিয়ে দিয়ে ব্যবসায়িক ফায়দা লোটার মতো কৌশল তারা অবলম্বন করেন না। বরং বিনয় ও ধৈর্যের সাথে সঠিক জিনিসটির জন্য সঠিক তথ্য দিয়ে থাকে। শুধু তাই নয়, ক্রয়কৃত কোনো জিনিস মনমতো না হলে কিংবা কোনো সমস্যা দেখা দিলে ছয় মাস বা এক বছর পরেও রিপ্লেস করে নতুন আরেকটি জিনিস নিয়ে বাসায় ফেরা যায় হাসতে হাসতে। এটাই এখানকার বাস্তবতা।
বিয়ে হচ্ছে তাদের ঐতিহ্যের আরেকটি বড় অংশ। বিয়েটাকে তারা জীবনের এক শক্ত বাঁধন ও বড় প্রাপ্তি হিসেবেই মনে করেন। এজন্য তারা এক দেখাতেই একে অন্যকে বিয়ে করে ফেলতে পারেন না। বিয়ের আগেই তারা একসঙ্গে সহবাস করে যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে ভালোভাবে একে অন্যকে জেনে নেন। এক্ষেত্রে বনাবনি না হলে বিয়ের আগেই তাদের সম্পর্ক চুকে যায়। স্বামী বা স্ত্রী খুঁজে নেবার জন্য কোনো ছেলে বা মেয়ে যদি অসংখ্যবারও কোনো সম্পর্কের স্থাপন বা ভাঙন ঘটায়, তাতে কোনো দোষ বা সামাজিক কলঙ্কের মুখিমুখি হতে হয় না। এমনকি কেউ যদি বিয়ের আগে সন্তানসম্ভবাও হয়ে যান তাতেও সমাজ তাকে ছিঃ ছিঃ করে না। বাবা ছেড়ে চলে গেলে মাতৃ-পরিচয়েই সন্তান বড় হয়ে উঠে। তবে বিয়ের আগে যে যেভাবেই চলুক না কেন বিয়ের পর তারা তাদের স্বামী-স্ত্রীর পবিত্র বন্ধনকে ধরে রাখার ক্ষেত্রে বদ্ধপরিকর।
বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয় বেশ মজা করেই। বিয়ের অানুষ্ঠানিকতার কাজ সম্পন্ন করার জন্য সাধারণত তারা হোটেলে গিয়েই উঠে। অনুষ্ঠানস্থলের নিকটবর্তী কোনো চার্চে গিয়ে একজন ধর্মযাজকের মাধ্যমে তারা বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ে অানুষ্ঠানিকতার পর্ব শেষ করে সবাই ফিরে আসেন হোটেলে। শ্যাম্পেনের গ্লাস হাতে নিয়ে জড়ো হন হ্লরুমে। ধর্মযাজক সবাইকে উদ্দেশ করে শ্যাম্পেনের গ্লাস উচিয়ে চিয়ার্স বলেন এবং গডের কাছে শুকরিয়া আদায় করার মাধ্যমে ডিনার শুরু করেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ডিনার শেষে (কখনো কখনো ডিনার চলাকালে) বর ও কনের ছেলেবেলাকার স্মৃতিবিজড়িত রসালো ঘটনাবলিকে তাদের ঘনিষ্ঠজনরা ছোট ছোট বক্তব্যের মাধ্যমে তুলে ধরেন, যা শুনে উপস্থিত অতিথিরা হাসির বন্যায় ভেসে যান। যিনি উপস্থাপনা করেন তাকে বলা হয় ব্যাটসম্যান। মদের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বক্তব্য শুনতে শুনতে এক পর্যায়ে তারা মেতে উঠেন নাচে আর গানে। আর এভাবেই কাটে পুরো মাতাল রাত।
আইরিশদের ঐতিহ্যের কথা বলে শেষ করা যাবে না। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা তাদের ঐতিহ্যকে এমনভাবে সমুন্নত করে রেখেছে, যা দেখে পর্যটকরা আকৃষ্ট না হয়ে পারেন না। খাদ্য ও পানীয় সামগ্রী থেকে শুরু করে শিল্পকলাসহ প্রতিটি শাখাই নিজ ঐতিহ্য ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে গর্বের সাথে। উদাহরণ দেয়া যাক। খাবারের ক্ষেত্রে : আইরিশ বিফ, আইরিশ স্মোক স্যালমন (এক ধরনের সামুদ্রিক মাছ), আইরিশ ব্রেকফাস্ট (দু স্লাইস বেকন, দুটো সসেজ, কিছু ভাজা আলু, গ্রিলড টমেটো, মাশরুম, পুডিং ও দুটো স্ক্রাম্বল, পোঁচড বা ফ্রাই এগের (ডিম) সমন্বয়ে সাজানো একটি প্লেট); পানীয় হিসেবে : আইরিশ বিয়ার (গ্যানিস), আইরিশ হুইস্কি (জেমিসন), আইরিশ কফি (হুইস্কি মিশিয়ে যে কফি তৈরি করা হয়) ইত্যাদি। এছাড়া আইরিশ ড্যান্স (মনোহরণকারী এক ধরনের নাচ), আইরিশ শ্যামরক (সৌভাগ্য ও প্রগতির প্রতীক) এসব বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজ জাতিসত্তার নাম ধরে রেখে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে বিদেশিদের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হচ্ছে।
রাজনীতিতে আইরিশদের খুব বেশি একটা আসক্তি নেই বললেই চলে। তারা প্রতিদিন নিয়মিত কাজে যান। ফিরে এসে সাজসজ্জা করে সন্ধ্যার আলোতে বেরিয়ে পড়ে পাব বা নাইট ক্লাবের উদ্দেশে। সেখানে গিয়ে পোল খেলে। আমরা যেভাবে রাজনৈতিক বাদানুবাদের মাধ্যমে চায়ের পেয়ালায় ঝড় তুলতে অভ্যস্ত, তারা ঠিক তেমনটি নয়। বিয়ারের গ্লাসের ভেতর স্বপ্ন দেখে রোমান্টিকতার। ইতিহাস, রাজনীতি বা সমাজনীতি কিংবা সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক কোনো কিছুই স্পর্শ করে না তাদের। কাজ, পান, খাওয়া, এগুলোতেই তারা খুঁজে পায় শান্তি, মহা শান্তি।
বিশেষ দ্রষ্টব্য : আয়ারল্যান্ডের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত। এসব নিয়ে আগামীতে আরও কিছু লেখার ইচ্ছে আছে।
লেখক : আয়ারল্যান্ড প্রবাসী
shajed70@yahoo.com
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ২২১৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৬, ২০১১