ঢাকা, রবিবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৮ মে ২০২৫, ২০ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

ব্লগার আলি মাহমেদের ‘আমাদের ইশকুল’

সমীর চক্রবর্তী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮:২৮, অক্টোবর ৩০, ২০১১
ব্লগার আলি মাহমেদের ‘আমাদের ইশকুল’

সমাজের ‘কর্তা’শ্রেণীর ব্যক্তিরা সহজে এই পল্লীর পথ মাড়ান না। আর যদিও যান তাহলে নাকে হাত চাপা থাকে।

তাছাড়া ওই এলাকার আশপাশে তাদের কেউ দেখে ফেললে নিজের মান কমতে পারে। লোকে মাদকাসক্ত ভাবতে পারে এমন ভয়ও কাজ করে মানুষের মধ্যে।

সবার কাছে এই এলাকার পরিচিতি মেথর পট্টি হিসেবে। বাস্তবতা যখন এমন কঠিন, তখন সেই এলাকায় নিয়ম করে সময় দিয়েছেন একজন মানুষ। ঘরে ঘরে গিয়ে বুঝিয়েছেন শিক্ষার গুরুত্ব। এর ফলস্বরূপ আজ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার হরিজন পল্লীতে জ্বলছে শিক্ষার আলো।

সকাল থেকেই বই নিয়ে ওই পল্লীর সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা ছোটে ব্লগার আলী মাহমেদের ‘আমাদের ইশকুল’-এ। আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ব্লগার আলী মাহমেদ ডয়চে ভেলের সেরা বাংলা ব্লগার প্রতিযোগীতায় বিজয়ী প্রথম বাংলাদেশী।

এই স্কুলের পরিচালনার কৌশলে রয়েছে ভিন্নতা। প্রথম এক ঘণ্টা খেলাধুলা আর মজার পর শুরু হয় প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা। বইপত্র, স্কুল ড্রেস, চিকিৎসা সবই বিনামূল্যে দেওয়া হয় স্কুল থেকে। তাছাড়া ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহ দিতে থাকে নানা পুরস্কারের ব্যবস্থাও।

গত শনিবার সকালে সরেজমিনে ওই স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে একটি টিনের ঘরে কমবেশি পনেরোজন শিক্ষার্থী ব্যস্ত পড়াশোনায়। এ পর্যন্ত কী শিখেছো জিজ্ঞেস করতে সবাই বলে উঠল, আমরা অ-আ-ক-খ, ১-২, ওয়ান-টু, নামতা সব পারি। কতজন নিজের নাম লিখতে পারো-- এমন প্রশ্নের জবাবে হাত তুলল সবাই। এরই ফাঁকে অজিত হরিজন নামে এক শিক্ষার্থী বলে উঠল, ‘আমি নিজের লগে বাপের নামও লেখতে পারি। ’ তাছাড়া ক্লাস রুমের বোর্ডে লাগানো তালিকায় লেখা আছে, নিয়মিত দাঁত মাঝতে হবে, নখ ছোট রাখতে হবে ইত্যাদি। পাশাপাশি বাড়তি সর্তকতা হিসেবে রয়েছে, রেল লাইনে উঠা যাবে না (হরিজন পল্লীর পাশেই রেল লাইন)। প্রতিদিনই স্কুলে এই নিয়মগুলো তাদেও স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়।

এ সময় আলী মাহমেদকে কাছে পেয়ে একের পর এক আবদার করতে থাকে অভিভাবক আর শিক্ষার্থীরা। কোনো শিক্ষার্থীর দরকার দাঁতব্যথার ওষুধ, তো কারো প্রয়োজন ভিটামিন বা কারো প্রয়োজন চকলেট। আয়নার মা (নিজের নাম বলতে নারাজ এক হরিজন) নামে এক অভিভাবক বায়না ধরে বললেন, ‘আমার পোলার মতো বড় পোলাদের লাইগ্যা পড়ার একটা ব্যবস্থা করে দেন বাবু। না পড়লে তো আমার পোলা বড় হইবো না। ’

এই স্কুলের শিক্ষক শেখ মো. শহীদুল ইসলাম বকুল বাংলানিউজকে জানান, প্রায় আড়াই বছর ধরে এ স্কুল চলছে। প্রথম প্রথম ঘরে ঘরে গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের ধরে আনতে হতো। এখন আর এমন অবস্থা নেই। শিশুদের আচরণের পরিবর্তন ঘটেছে। অভিভাবকরাও সচেতন হয়েছেন। অনেক নারী ও বৃদ্ধরাও পড়তে চাইছেন। প্রথমে একটি খোলা জায়গায় পড়া শুরু করলেও এখন একটি টিনের ঘর হয়েছে। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ২০ জন।

ব্লগার আলী মাহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, আমি বিশ্বাস করি আমার ছেলের পড়ার অধিকার থাকলে হরিজন পল্লীর ওই শিশুদেরও পড়ার অধিকার আছে। সেই বিশ্বাস থেকেই আমি স্কুলটা চালিয়ে নিচ্ছি। এই শিশুগুলো যখন নিজের নাম লিখতে পারে তখন আমার খুব ভালো লাগে। তবে অর্থকষ্টে স্কুলটা চালিয়ে নেওয়া কষ্টকর হয়ে পড়ছে।
তিনি এ বিষয়ে সবার সহযোগিতা কামনা করেন।

আমরাও মনে করি, আলী মাহমেদের এ উদ্যোগে সহযোগিতা করা খুব দরকার। পাশাপাশি আমাদের অনেকেরই আশপাশে রয়েছে এমন বহু জনগোষ্ঠী, যাদের সাধ্যমতো শিক্ষিত ও সচেতন করে তোলা আমাদের প্রতেকেরই দায়িত্ব।  

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৮১৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।