রাত আটটা। হাওড়া স্টেশনের আট নম্বর প্লাটফর্মে শিলিগুড়ি এক্সপ্রেস দাঁড়ানো।
সকাল সাতটা নাগাদ শিলিগুড়ি স্টেশনে যখন গাড়ি, তখন হালকা ঘুমের আবেশে আছি। হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নাশতা পর্ব সেরে সোজা টয় ট্রেন ধরব বলে কাউন্টারে। টিকিট না পেয়ে বিকল্প চিন্তায় শিলিগুড়ি বাস টার্মিনাল। দার্জিলিং পর্যন্ত মাথাপিছু ভাড়া ৮০ রুপি টাটা সুমো জিপ। আটজনের জায়গায় আমরা পাঁচজন। আরও তিন যাত্রী নিয়ে অবশেষে পথ চলা শুরু। পাহাড়ি পথ একেবেকে, কোথাও সমকোণে ওপর দিকে। এক পাশে খাড়া পাহাড়, অন্যপাশে গিরিখাত। এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে ক্রমেই আমরা ওপর দিকে চলেছি। চালকের দক্ষতা প্রশংসনীয়। কুয়াশায় ঢাকা পথ, কনকনে ঠাণ্ডা। ঘণ্টাখানেক বাদে এক জায়গায় দাঁড় করাল গাড়ি। সামনেই চা দোকান। সবাই চা খেলাম তৃপ্তি নিয়ে। চায়ে কেমন যেন দার্জিলিং দার্জিলিং স্বাদ। চলার পথে একটু পরপরই এরকম চায়ের দোকান পর্যটকদের স্বার্থে ।
দীর্ঘ পাঁচ ঘণ্টা পাহাড়ি রাস্তা পেরিয়ে আমরা যখন ঘুম নামের স্টেশনটিতে পৌঁছলাম, দেখলাম ঠিক নামের সাথে সখ্য বজায় রেখেছে জায়গাটা। চারদিক কুয়াশায় ঢাকা। নিশ্চুপ ঘুমন্ত একটা জায়গা। শিলিগুড়ি থেকে আসা টয় ট্রেন এখানে যখন থামে তখন কিছুটা জেগে উঠে এই ঘুম স্টেশন । তাও দিনে মাত্র দুই বার। অন্য সময় দেখে মনে হবে যেন কোনো ঘুমের রাজ্য। জনমানবহীন এক ছোট স্টেশন। স্টেশন মাস্টার ছাড়া কাউকে দেখা যায় না অন্য সময় । আরও কিছুটা পথ এগিয়ে দার্জিলিং বাস টার্মিনাল। আমাদের বয়ে আনা টাটা সুমো থামল ওখানেই। পাশেই পাহাড়ের গা ঘেঁষে সারি সারি হোটেল। এখানেও দালালদের ব্যাগ টানাটানি। নিজেদের হোটেলে নিয়ে যেতে পারলে কমিশন পাবে তারা। অবশেষে আমরা নিজেরাই বাছাই করে একখানা হোটেলে উঠে পড়লাম। বিরাট কামরায় আমরা পাঁচজন এক সাথে । থাকা খাওয়া জনপ্রতি দিন ১৭৫ রুপি। রাজ্যের ক্লান্তি সবার। তবু রাতের খাবারের পর বের হলাম শহর ঘুরে দেখতে। ছোট শহর। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। পরদিন দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখার জন্য একখানা টাটা সুমো ভাড়া করে এলাম।
ভোর ৪টায় টাইগার হিলের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হলো আমাদের, প্রথম সূর্যোদয়ের অপূর্ব সৌন্দর্য লাভের অভিলাষে। যখন পৌঁছলাম তখনও চারদিক আঁধার। সেই সাথে রাস্তার দু পাশে বরফের চাদর বিছানো। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে অনেক সময় মেঘে ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা দেয় লজ্জা ভুলে। আমাদের প্রত্যাশা আজ আমরাও দেখব। শয়ে শয়ে দর্শনার্থীদের চোখের সামনে সকালের লাল সূর্য আপন মহিমায় উদয় হলো। সেই অপার্থিব সৌন্দর্য না দেখলে কারো অনুভূতিতে জাগানো অকল্পনীয়।
ঘুম বৌদ্ধ মন্দির। হাজার বছরের পুরনো নিদর্শন। স্থাপত্যশিল্পের এক অপরূপ সৃষ্টি। ভেতরের মূর্তিগুলো কালের সাক্ষী বহন করে। অতঃপর হোটেলে ফিরে নাস্তা পর্বের শেষে আমাদের গন্তব্য প্রায় ৬ হাজার ফিট নিচে কিছুটা সমতলে বানানো রক গার্ডেন ও গঙ্গা মাইয়া।
পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণে আমাদের লাল জিপটা নিচে নামছে সাঁ সাঁ করে। দু পাশে চা বাগান। মাঝখান দিয়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা। মাঝে মাঝে পাহাড়ি বাঁশ বাগান। মনে হয় এই বুঝি জিপটা উল্টে গেল! প্রথমেই রক গার্ডেন। এর একদিকে পাহাড়ের গা ঘেঁষে কয়েকটা ঝরনা পর পর। অন্যদিকে সুন্দর মনোরম বাগান। পর্যটকদের বসার জায়গা। লোহার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠার ব্যবস্থা, ঝরনার কাছাকাছি যাওয়ার জন্য। ঘণ্টাখানেক সেখানে কাটিয়ে আবারও মিনিট পঞ্চাশের পাহাড়ি পথ পেরিয়ে যখন গঙ্গা মাইয়াতে পৌঁছলাম বেলা গড়াচ্ছে দুপুরের দিকে। পাহাড়ি ঝরনা নদীর রূপ নিয়েছে সমতলে। হঠাৎ গায়ে লাগা ঠাণ্ডা বাতাস ঝরনার জানান দেয়। আর একে ঘিরেই এই বিশাল উদ্যান। পাহাড়ের ফাটলে নানা প্রজাতির পাখিদের কিচির-মিচির আর কোলাহল বাড়তি পাওনা। পাহাড়ি নৃত্য পরিবেশিত হয় প্রতিদিন সকাল থেকে, একপাশের বিশাল মঞ্চে। দর্শনার্থীদের আনন্দ দেওয়ার জন্যই এই ব্যবস্থা। আজও এর ব্যতিক্রম নয়। কিশোরী মেয়েরা নাচছে বাজনার তালে তালে, নানা বর্ণের পোশাক পরে। উদ্যানের একেবারে শেষ মাথায় সর্পিল রাস্তা অনেকটা দূর পর্যন্ত। দেখার মতো দৃশ্য। রাস্তার শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে দেখা যায় দূরে দুটি পাহাড় একসাথে মাটিতে মিশে আছে, ইংরেজি ভি-এর মতো করে। চমৎকার দৃশ্য। অতঃপর হোটেলে ফিরেই দুপুরের খাওয়া-দাওয়া।
বিকেলে গন্তব্য এক সময়ের ঘোড়দৌড়ের জায়গা, আজ সেনাবাহিনীর প্যারেড গ্রাউন্ড। আর তার পাশেই রয়েছে পাহাড়ের গা ঘেঁষে বিশাল স্টেডিয়াম। এর একপাশে পাহাড় আর অন্যপাশে কয়েক হাজার ফুট নিচু খাদ। পাহাড়ের গা ঘেঁষে দর্শক গ্যালারি।
সবশেষে চা কন্যার দেশের চা বাগানে কিছুক্ষণ। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে ঝিরি ঝিরি ঠাণ্ডা বাতাসে বাগানের পাশে দাঁড়িয়ে আমেজে চা খাওয়া এক সুখকর অনুভূতি। তারপর শহরে ফিরে কিছু কেনাকাটা। বিশেষ করে দার্জিলিংয়ের চায়ের কয়েকটি কোয়ালিটি না নিলে যেন ভ্রমণের রঙই ফিকে হয়ে যায়!
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৬৫৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০১১