বাগেরহাট: অতিথিপরায়ণতার জন্য বাংলাদেশিদের সুনাম পৃথিবীজুড়ে। শুধুমাত্র মানুষকে আতিথেয়তা করার জন্যই নয় এই সুনাম।
তবে সত্যিকার অর্থেই কি পাখিদের অভয়ারণ্য আছে এখনও। জায়গায় জায়গায় ফাঁদ আর পাখি শিকারীদের কবলে পড়ে আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে পাখিরা। পাখিরা হলো প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখার অন্যতম উপাদান। নানা ভাবেই প্রতিনিয়ত প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রেখে চলেছে তারা।
তবে এই চিত্র পাওয়া যাবে না অন্তত বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলায়। এই অঞ্চলের মানুষজন অনেকটাই পাখি সচেতন। আর তাইতো বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট উপজেলার সাতশৈয়া গ্রামের গোলাম আজমের স্ত্রী শারমিন সুলতানা বলেন, ‘এই পাখি আমাদের সম্পদ। গ্রীষ্মে আসে, শীতকালে চলে যায়। আমরা এই সম্পদকে ধ্বংস হতে দিতে পারি না। ’
বিলুপ্ত প্রজাতির পাখি এবং বর্তমানে এদের সংরক্ষণে কি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এমন প্রশ্ন নিয়ে কথা হয় পাখি রক্ষা কমিটির সভাপতি মিজানুর রহমান খোকনের সঙ্গে। এ বিষয়ে তিনি জানান, ‘বিলুপ্ত প্রজাতির পাখিসহ অন্যান্য পাখি যাতে এই এলাকায় নিধন না করা হয় সে জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। বর্তমানে এই কমিটির সদস্য সংখ্যা ৫৩ জন। এই এলাকায় অতিথি পাখিসহ বিলুপ্ত প্রায় পাখিগুলো বেশ স্বাচ্ছন্দেই বিচরণ করে। ’
তবে পাখি বিশেষজ্ঞ শরিফ খাঁনের কাছে হালতি পাখি নিয়ে জানতে চাইলে তিনি এই পাখিকে দুর্লভ পাখি বলে অভিহিত করেন। এই পাখি বছরের মার্চ-এপ্রিলে ওই এলাকায় আসে। আবার অক্টোবর মাসের প্রথম দিকেই চলে যায়। এরা গ্রীষ্মকালে এই অঞ্চলে আসে। তবে শীত আসতে আসতেই আবার চলে যায় এই পাখিরা।
এই পাখিদের আচরণ ও জীবনযাত্রা সম্পর্কে এই পাখি বিশেষজ্ঞ জানান আরও মজার অনেক তথ্য। মার্চ মাসে মূলত এক জোড়া হালতি পাখি তাদের বাসা তৈরি করে। সেপ্টেম্বর মাসে ডিম দিয়ে বাচ্চা ফোটার পর বাচ্চাকে নিয়ে অক্টোবরে চলে যায় নিজ দেশে। দুরন্তপনার দিক দিয়ে তুলনা নেই এই পাখিদের। বাচ্চাগুলো দেখতে অনেকটা দেশি মুরগীর বাচ্চার মতো। এদের গায়ের রং হয় কুচকুচে কালো। আর ঠোঁট হয় লাল। তবে এরা বড় হয়ে গেলে এদের গায়ের রং হয়ে যায় বাদামি-কালচে। আর এদের আছে প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ। খরা-বর্ষার আগাম সংকেত দিতে জুরি নেই তাদের। বর্ষা আসার আগেই আগের বাসা পাল্টে অনেকটা উঁচুতে তৈরি করে নেয় নিজেদের বাসা।
প্রায় আট বিঘা জমির উপর বাগান বাড়ি গোলাম আজমের। সুপারি-নারকেল গাছ আর ঝোপঝাড় দিয়ে বাগানটি যেন পাখিদের বসবাসের জন্য অভয়ারন্য। গত মার্চ মাসের দিকে বসত ঘরের প্র্রায় ২০ গজ দূরে মাটি থেকে ৪ ফুট উচুুতে ঝোপের ভেতরে বাসা তৈরি করে এক জোরা অচেনা পাখি। ওই অচেনা পাখির চলাফেরা দেখে পরিবারের সকলের মধ্যে তৈরি হয় বেশ কৌতুহল। অচেনা এই পাখির খবর শুনতে পেয়ে গ্রামের শত শত মানুষ ছুটে আসে গোলাম আজমের বাড়িতে একবার পাখিতে দেখার জন্য। রীতিমত হিমশিম খেতে হয় গোলাম আজম পরিবারকে এই ভীড় সামলাতে। দীর্ঘ কয়েক মাস পরে ওই অচেনা পাখির সাতটি ডিম হয়। টানা ২১ দিন পর সেই ডিম থেকে সাতটি বাচ্চা ফোটে। এতে করে আরও বেকায়দায় পড়ে যান গোলাম আজম পরিবার। শেষমেষ এই পাখির পরিচয় জানতে তারা শরণাপন্ন হন পাখি বিশেষজ্ঞ শরিফুল ইসলামের কাছে। পরবর্তীতে তিনি ঢাকা থেকে এসে পাখিগুলোতে ‘হালতি পাখি’ বলে সনাক্ত করেন।
পাখিগুলো সম্পর্কে ওই এলাকার প্রবীণ জালাল শেখ জানান তার অভিমত। তিনি বলেন, এ রকম পাখি কোথাও কোন সময়ে দেখা যায়নি। পাখিটির বাচ্চাগুলো দেখতে খুব সুন্দর। সবচেয়ে অদ্ভুত এদের চলাফেরা। খুব জোরে দৌড়াতে পারে এই পাখিগুলো।
পাখির ডানায় ভর করে আমাদের স্বপ্ন চলে দুর্নিবার। সেই শৈশবে পাখি হতে চায়নি এমন মানুষ পাওয়া খুব কমই পাওয়া যাবে। তবু বাস্তব হলেও সত্যি আমরাই এই পাখিদের নির্মমভাবে নিধন করছি নিজেদের প্রয়োজনে, অনেকসময় শুধুমাত্র সৌখিনতার জন্যও। এরকম যদি চলতে থাকে, তাহলে হয়তো অদূর ভবিষ্যতে আমাদের অনাগত প্রজন্ম আর হতে চাইবে না পাখি। তাই হালতি পাখির মতো অন্য সব পাখিদের বাঁচাতে এগিয়ে আসতে হবে আমাদের সকলকেই। অন্তত নিজেদের বেঁচে থাকার তাগিদে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭২৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০১, ২০১১