দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং আলোচ্য বিষয় ‘কিয়োটো প্রটোকল’। কারণ ২০১২ সালের মধ্যে শেষ হতে যাচ্ছে কিয়োটো চুক্তির মেয়াদ।
এরই সঙ্গে নির্ধারিত হতে যাচ্ছে সারা পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের ভবিষ্যৎ। তাই এই চুক্তির মেয়াদ বাড়াতে এবং ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে ডারবানের জলবায়ু সম্মেলন। বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম আতংক নিয়ে তাকিয়ে আছে এ সম্মেলনের দিকে। এ চুক্তির মৃত্যু হলেই মৃত্যু হবে জলবায়ুর।
কী আছে এই চুক্তিতে? কিয়োটো প্রটোকল হল United Nations Framworks Convention on Climate Change (UNFCCC) কর্তৃক তৈরি করা এমন একটি আইন যা বিশ্বের তাপমাত্রা ও কার্বন নিঃসরণকে দমিয়ে রাখার এক অভিনব উপায়। কার্বনের মাত্রা ভয়াবহভাবে বেড়ে গিয়ে পৃথিবীকে বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দেওয়া থেকে উদ্ধার করার জন্যেই মূলত এই চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়।
দুঃখজনক হলে সত্যি যে, ১১ ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে জাপানের কিয়োটোতে যদিও এ চুক্তি সই করা হয়েছিল কিন্তু পরিবেশ রক্ষায় চুক্তিটি কার্যকর করা হয় ১৬ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৫ সাল থেকে। কার্যকর করতেও দীর্ঘ সময় নেওয়া হয়েছিল। চুক্তি সাক্ষরের সময় বিশ্বের শিল্পোন্নত ৩৭টি দেশ দূষণমাত্রা ৬০% কমাতে রাজি হলেও পরবর্তিতে ভারত, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলের উদীয়মান অর্থনীতি দেখে তারা ৩০% কমাতে চাইলো। যা ছিল হতাশাজনক।
কিন্তু এখন কিয়োটো চুক্তির মেয়াদ শেষের সময় এসে বিশ্বের অন্যতম কার্বণ নিঃসরণকারী দেশগুলো - কানাডা, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে, তারা এই চুক্তি নবায়নের পক্ষে নয়। এমন কি কিয়োটো প্রটোকল চুক্তির আয়োজক দেশ জাপানও এই চুক্তির ধারাবাহিকতা রাখতে আর রাজি নয়। কী হবে এখন? যখন আমাদের মতো দেশগুলো আশা করছিল এই চুক্তি নবায়নের তখন তাদের ‘না’ আমাদের বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
কিয়োটো প্রটোকলের এই অঙ্গিকারের জন্য শিল্পোন্নত ও উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলি এতদিন কার্বন কমাতে বাধ্য ছিল। ২০১২ সালের পর যদি এই চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো না হয় তাহলে আফ্রিকার ডারবানেই কিয়োটর মৃত্যু হবে। ফলে বাংলাদেশের মতো জলবায়ু বিপন্ন দেশগুলো আরো ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।
জার্মান ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা জার্মান ওয়াচ গ্লোবাল ক্লাইমেট রিক্স ইনডেক্সের তথ্য অনুযায়ী ১৯৯১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ৭ লাখ ১০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে, ১৪ হাজার প্রাকৃতিক দূর্যোগের সৃষ্টি হয়েছে, আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ২ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলার।
গত দুই বছর বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জলবায়ু বিপন্নদেশের তালিকায় শীর্ষে ছিলো। এখন যদিও ৩ নম্বরে আছে তাও এটি কোন আশা জাগানো মতো খবর নয়।
কিয়োটো চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো ও ধারাবাহিকতার ওপর আমাদের তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ অনেকাংশেই নির্ভরশীল। পৃথিবীতে কার্বনের পরিমান বেড়ে গেলে বাংলাদেশের ওপর তার প্রভাব পড়বে সরাসরি। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দূর্যোগ আরো বেড়ে যাবে, নিচু এলাকাগুলি পানিতে ডুবে যাবে , মানুষ ভূমিহীন হয়ে পড়বে, খাদ্য সংকট হবে, অসুখ-বিসুখের মাত্রা বেড়ে যাবে, মৃত্যুহার বেড়ে যাবে, অর্থনৈতিক অবস্থাও নড়বড়ে হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ।
কথায় আছে ‘লঘু পাপে গুরু দন্ড’ । যেখানে আমরা কোন পাপই করিনি, সেখানে আমরা কেন শিল্পন্নোত ও উদীয়মান অর্থনীতির দেশের পাপের ফল ভোগ করবো?
এই সব শিল্পোন্নত ও উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর উচিত নিজের দোষ স্বীকার করে অন্তত বিশ্বকে বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচাতে এবং মানবতার খাতিরেও কিয়োটো প্রটোকলের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা।
কিয়োটো প্রটোকলের ধারাবাহিকতা নিয়ে এখনো ডারবানে তর্ক-বিতর্ক চলছে। তাই আমরা এখনো এতো তাড়াতাড়ি আশা হারাতে চাই না। ডারবানের জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশ ও আমাদের মতো ভুক্তভোগী দেশগুলোর প্রতিনিধিরা শক্তভাবে কিয়োটো প্রটোকলের ধারাবাহিকতার পক্ষে কথা বলবে-এই প্রত্যাশা করছি। সেই আমাদের তরুণ প্রজন্মকে সোচ্চার হওয়ার প্রসঙ্গও টানবো। কারণ এ চুক্তির মৃত্যু মানে আমাদেরই মৃত্যু হবে। আমরাই এ বিপর্যয়ে পড়ে যাবো। আমাদের নিজেদের ভবিষ্যত নিশ্চিত করতেই আমাদেরই সোচ্চার হতে হবে।
প্রজ্ঞা পারমিতা মজুমদার
ইন্টারন্যাশনাল ক্লাইমেট চ্যাম্পিয়ন, ব্রিটিশ কাউন্সিল
proggnaparomita@gmail.com